খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ ব্যাংক কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ পুনঃতফসিল, অবলোপন ও এককালীন পরিশোধের নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন খেলাপি ঋণ কমছে না, তা খতিয়ে দেখতেও বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমাতে হবে।
গত রোববার দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, সব ডেপুটি গভর্নর এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। এই ঋণের মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির অংশ যেমন আছে, তেমনি কিছু ব্যবসায়ী এবং ভালো উদ্যোক্তাও খেলাপি ঋণগ্রস্থ হয়েছেন। কঠোর ঋণ নীতিমালার প্রভাবেও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। সভায় কৃষি ও এসএমই খাতেও ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এই দুই খাতে ঋণ বাড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়।
দুই বেসরকারি ব্যাংকের এমডি, যারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, আগে ঋণে কোনো সমস্যা হলেই তা খেলাপি হিসেবে গণ্য হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ নিয়ে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো নেতিবাচক মন্তব্য করছে। বড় অঙ্কের ঋণ আটকে থাকায় ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমেছে। তাই দ্রুত খেলাপি ঋণ কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
খেলাপি ঋণের ৭৭% বড়দের মধ্যে আটক:
ব্যাংকার্স সভায় তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ আছে এমন ৫০ শিল্প গ্রুপের মোট ঋণ ১০ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৬২.৫৯ শতাংশ। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ৭৭ শতাংশই বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে আটকে আছে।
বড় ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ২ লাখ ৮৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা, যা ২৭.১১ শতাংশ। এছাড়া সব মিলিয়ে মামলায় আটকে আছে ৪ লাখ ৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ঋণ। শীর্ষ ৫০ শিল্প গ্রুপের কাছে সরাসরি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকার। তবে এই শিল্প গ্রুপগুলোর নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা বাড়ছে:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। ব্যাংকগুলোও ঋণ আদায়ে তৎপরতা বাড়িয়েছে এবং মামলা করছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ১৪ হাজার ৬৫২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে অর্থঋণ আদালতে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৩৪১। এসব মামলায় আটকে আছে ৪ লাখ ৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ২ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৩টি মামলায় আটকে ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। সভায় ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মামলার স্থগিতাদেশ শূন্য করার।
এছাড়া চলতি বছরে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা বাড়িয়ে সাতটি করা হয়েছে, আগে চারটি ছিল। পলাতক ব্যবসায়ীদের প্রায় সব ঋণের বিপরীতে মামলা করা হয়েছে। এপ্রিল-জুন সময়ে ১১ হাজার ৯৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। একই সময়ে নতুন ১৪ হাজার ৬৫২টি মামলা দায়ের হয়েছে।
বিশেষ অনুমতি ও পুনঃতফসিল:
রোববারের সভায় এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, মাত্র ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন জমা পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঁচ সদস্যের কমিটির কাছে ১ হাজার ৫১৬টি আবেদন এসেছে, যার বিপরীতে ঋণ ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ ব্যবসায়ী গ্রুপ পুনঃতফসিল চেয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৩০০ ব্যবসায়ীর ৯০০ আবেদন নিষ্পত্তি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো ২৫০টি আবেদনের বিপরীতে ২৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এতে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। বাকি আবেদনগুলোর বিষয়ে ব্যাংকগুলো সাড়া দেয়নি।

