ব্যাংকিং জগতে ‘নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি’ শব্দটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে একটি সুপরিচিত কৌশল। বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী কেন তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, তা বোঝাতে এটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে এই কৌশল এখন ব্যাপকভাবে পরীক্ষা হচ্ছে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রায় ৩০০টি কোম্পানি থেকে ২ লাখ কোটি টাকার ঋণ পুনঃনির্ধারণের আবেদন এসেছে। এই তালিকায় রয়েছে আলোচিত বড়দের মতো এস আলম এবং বেক্সিমকো গ্রুপ।
তাদের চাহিদা চমকপ্রদ, ঋণের পরিশোধ সময়সীমা ১৫ বছর পর্যন্ত, ৩ বছরের গ্রেস পিরিয়ড এবং মাত্র ১–২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট। কোনও আবেদন গ্রহণের আগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সঠিক শ্রেণিবিভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্পষ্টভাবে আলাদা করতে হবে—সত্যিকারের দেউলিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যারা বাজার ঝুঁকি বা বৈশ্বিক সরবরাহ শকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, আর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণী’ যারা নিয়মিত ব্যবস্থাকে প্রতারণার জন্য ব্যবহার করে। যদি সবকিছু এক রকম নীতি অনুসারে মওকুফ করা হয়, তবে দুর্ভাগ্যবানদের সঙ্গে অনৈতিকদের মিলিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি থাকবে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ইচ্ছাকৃত ঋণীদের প্রতি সদয় হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
অপরাধী ঋণের পরিমাণ এখন রেকর্ড ৬,৪৪,০০০ কোটি টাকা, যা সব ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ—এমন অবস্থার মুখোমুখি ব্যাংকিং সিস্টেম ২০০০ সালের পর আর দেখেনি। তবুও অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা শিথিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, “নীতিগত সমর্থন” প্রয়োজন। কিন্তু এই সমর্থন শুধুমাত্র তাদের জন্য হওয়া উচিত যারা সত্যিই বেঁচে থাকার জন্য সহায়তা প্রয়োজন, যারা কেবল ঋণ পরিশোধ এড়াতে চায় তাদের জন্য নয়।
ব্যাংকগুলো এখনও মামলার জালে আটকে আছে, যা একদিকে জেদি ঋণীদের সুবিধা দিচ্ছে। জুন পর্যন্ত ২,২২,০০০টির বেশি মামলায় ৪ লাখ কোটি টাকার ঋণ আটকে রয়েছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকরা কোর্টের মাধ্যমে মাত্র ২,৯১০ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে, যদিও নতুন মামলার পরিমাণ প্রায় ৯৭,০০০ কোটি টাকা। স্পষ্টতই, এই বিচারিক জট বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই দুই প্রক্রিয়ার সমন্বয়—ঋণ পুনঃনির্ধারণের চাপ এবং বিচারিক জট—ই ইচ্ছাকৃত ঋণীদের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। কেন আজ ঋণ পরিশোধ করবেন, যখন এক দশক ধরে মামলা চালিয়ে ব্যাংককে বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব, বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১৫ বছরের ছাড়ের আবেদন করা যায়? তাই সেপ্টেম্বরের “বিশেষ ঋণ পুনঃনির্ধারণ নীতি” ইচ্ছাকৃত ঋণীদের দ্বারা অপব্যবহার হতে দেওয়া যাবে না। এই নীতি সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য, প্রতিরোধ নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃত ঋণীদের ‘অশ্রেণীবদ্ধ’ অবস্থায় রাখে এবং মাত্র সামান্য ডাউনপেমেন্টে ঋণ মওকুফ করে, তাহলে এটি সেক্টরের অবনতিশীল স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করা হবে। এমন নীতি ব্যাংকিং সিস্টেমকে একটি জীবন্ত মৃত বা জম্বি ব্যাংকিং সিস্টেমে পরিণত করবে, যেখানে অদক্ষ ঋণীরা বাঁচানো হবে, অথচ সেই অর্থ প্রকৃত ও সততার সঙ্গে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাওয়ার কথা।
সুতরাং, ভবিষ্যতে ঋণ পুনঃনির্ধারণ কেবলমাত্র কঠোর, স্বাধীন অডিটের ভিত্তিতে হওয়া উচিত, যা প্রকৃত ব্যবসায়িক ব্যর্থতা এবং হিসাবনিকাশযোগ্য কৌশলগত ভুলকে আলাদা করতে পারবে। উদারতা শুধুমাত্র প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে হবে। পাশাপাশি, সরকারকে প্রয়োজনে বিশেষ আর্থিক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে বিচারিক জট দূর করতে হবে।

