ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালের শেষের দিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঋণ কেলেঙ্কারি, নিয়মের অবহেলা এবং এস আলম গ্রুপের জালিয়াতি একসময়ের সবচেয়ে লাভজনক এই ব্যাংককে আজ গভীর সংকটে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার ৮৬০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি এখন নন-পারফর্মিং লোন (NPL) যা ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মাত্র এক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৮৮ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১৭ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ শতাংশ। আজ ব্যাংক ৮৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির মুখে, যা তারল্য সংকট এবং ক্ষতির মাত্রা তুলে ধরে।
এস আলম গ্রুপ দীর্ঘ সাত বছর ধরে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে গোষ্ঠীটি ব্যাংকের বোর্ড নিয়ন্ত্রণে এনে নিজস্ব ও ছায়া কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল ঋণ নিয়েছিল। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত তারা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ৬৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা এখন খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, ঋণগুলো নেওয়া হয়েছে গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে। সাইফুল আলম ও তার শীর্ষ কর্মকর্তারা বর্তমানে পলাতক, তাই তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নাবিল গ্রুপও প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। যদিও গ্রুপের এমডি দাবি করেছেন, তাদের নথিভুক্ত ঋণগুলো নিয়মমাফিক এবং খেলাপি নয়। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের অন্যান্য বড় ঋণগ্রহীতার মধ্যে রয়েছে নাসা গ্রুপ, নোমান গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, যমুনা টায়ার, জিএমএস গ্রুপ, মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ডেল্টা গ্রুপ, বসুন্ধরা মাল্টিফুড গ্রুপ ও মাহমুদ ডেনিমস লিমিটেড।
ইসলামী ব্যাংক আরও পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংককে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যার একটাও ফেরত আসেনি। এছাড়া রাষ্ট্রীয় জনতা ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে। তবে নতুন একীভূত ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে এই ঋণ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৬৩৫ কোটি টাকা, যা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে ২০২৪ সালে তা কমে ১০৯ কোটি টাকায় নেমে আসে। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৯৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ২৬৭ কোটি টাকার তুলনায় অনেক কম।
ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য ৪৮৮টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ৩৪টি মামলা ঋণ আদালতে, যার দাবির পরিমাণ ৬৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এছাড়া ৩৭৭টি ফৌজদারি মামলা এবং ১ হাজার ৮৮১টি সাধারণ মামলা চলছে। স্টক/সম্পদ বিক্রি সংক্রান্ত ১০টি মামলা আছে, যার মূল্য ২৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
এস আলম গ্রুপের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কারণে ৪ হাজার ৬৮৫ জন কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ব্যাংক নতুনভাবে ২ হাজার ৫৭১ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার, মেসেঞ্জার, গার্ড এবং নিরাপত্তাকর্মীসহ নতুন নিয়োগ চলছে ব্যাংকের পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে।
ইসলামী ব্যাংকের এমডি ও সিইও ওমর ফারুক খান বলেন, ব্যাংকের তারল্য এখন শক্তিশালী। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য নানাভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। নগদ অর্থ পুনরুদ্ধার এখন প্রধান অগ্রাধিকার। তবে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের লক্ষ্য খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশে আনা।

