ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেমন দ্রুত বাড়ছে, তেমনি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে এসব ঋণের মান। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৯১ শতাংশই এখন মন্দমান বা আদায় অযোগ্য। এই প্রবণতা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব ঋণের বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ঋণগ্রহীতা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় ঋণ আদায় আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দমান বা আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। মোট খেলাপির মধ্যে যার অংশ ৯০ দশমিক ৮১ শতাংশ। এক বছর আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তখন আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা, যা ছিল ৮১ দশমিক ৬১ শতাংশ।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়া মানে সেটি বড় ধরনের সতর্কসংকেত। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের নতুন বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। একই সঙ্গে এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এতে ব্যাংকের আয়ে সরাসরি চাপ পড়ে।
নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণীকরণের তিনটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দমান বা ক্ষতিজনক। নিম্নমানের ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দমান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মন্দমানের খেলাপি ঋণের বড় অংশ জমা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। এটি এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের ঋণ এক লাখ ৪৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৯৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকে। ব্যাংকটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এটি জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপির ৭২ শতাংশ। এরপর রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২৯ হাজার ৩২১ কোটি টাকা বা ৪০ দশমিক ৩১ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা বা ৪৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ১৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বা ২২ দশমিক ৩২ শতাংশ। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের মন্দ ঋণ আট হাজার ৭৫২ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৯৫৩ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও মন্দ ঋণের চাপ বাড়ছে। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ চার লাখ ১৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৯০ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের। এর পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৫৮ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংক ৩১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এবি ব্যাংক ২৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক ২৬ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২৬ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংক ২৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা।
এদিকে, সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ২৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এসব ব্যাংকে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। যা পুরো ব্যাংক খাতের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

