অন্তর্বর্তী সরকার দেশে প্রথমবারের মতো সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি বিশেষায়িত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্য নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করেছে এবং অংশীজনদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত ব্যাংকটি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে ক্ষুদ্র ও উদীয়মান উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে কাজ করবে। ব্যাংকের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো ঋণগ্রহীতারাই প্রধান শেয়ারধারী হবেন। এছাড়া, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে পরিচালিত হবে।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো সেবা দিলেও লাইসেন্সিং, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্ব থাকবে না বাংলাদেশ ব্যাংকের। এটি দেখভাল করবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকিং বিধিনিষেধ থেকেও ব্যাংকটি অব্যাহতি পাবে। অর্থনীতিতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দাবি থাকলেও আগের কোনো সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। গত ১৭ মে, আগারগাঁওয়ে এমআরএর নতুন ভবন উদ্বোধনের দিন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের গুরুত্ব উল্লেখ করেন। এরপর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও এমআরএর সহায়তায় খসড়া অধ্যাদেশ প্রস্তুত করা হয়।
খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংক সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নিতে পারবে। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণদানকারী এনজিওগুলো কেবল সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয় নিতে পারে। ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংকটি সামাজিক ব্যবসা হিসেবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করবে। তবে এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে না।
প্রস্তাবিত ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা এবং প্রারম্ভিক পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ দেবেন ঋণগ্রহীতা-শেয়ারমালিকরা এবং ৪০ শতাংশ উদ্যোক্তারা। পরিচালনা পর্ষদে সাতজন থাকবেন; তিনজন ঋণগ্রহীতা-শেয়ারমালিকদের মনোনীত, তিনজন অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের মনোনীত এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদাধিকারবলে থাকবেন।
ব্যাংকের কার্যপরিধিতে থাকবে ক্ষুদ্র ব্যবসায় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ, কৃষি ও শিল্পের জন্য ভৌত সম্পদ সরবরাহ, কারিগরি ও বিপণন পরামর্শ, বিমা সুবিধা এবং সঞ্চয় ব্যবস্থাপনা। এটি স্থানীয় ও বিদেশি সহায়তা ও অনুদান নিতে পারবে, তবে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন করা যাবে না।
খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে অংশীজনরা বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরেন। এরপর অতিরিক্ত সচিব মো. সাঈদ কুতুবকে প্রধান করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এই উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগও আছে। সিপিডির অতিরিক্ত পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, অনেক কার্যক্রম ইতিমধ্যেই বিদ্যমান ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানই করতে পারে। নতুন ব্যাংক না করে এমআরএকে শক্তিশালী করাই যৌক্তিক। তিনি আরও বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা তৈরি করতে পারে এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যও প্রয়োজন।
এমআরএ জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে ৭২৪টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান আছে, যা চার কোটি’র বেশি সদস্যকে সেবা দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণ, সঞ্চয় সংগ্রহ ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। খাত সংশ্লিষ্টরা নতুন ব্যাংক বিষয়ে লিখিত মতামত দিয়েছেন। তাদের অনেকের মতে, ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ নয়, বরং ‘ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যাংক’ হওয়া উচিত এবং লাইসেন্সিং দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা উচিত।
ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, খাতের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যাংক হতে পারে, তবে বিধান প্রণয়নে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে, তবে আইন মেনে এবং সুফল-কুফল যাচাই করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্রঋণ বা ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভারতের ‘বন্ধন ব্যাংক’সহ একাধিক স্মল ফিন্যান্স ব্যাংক সফলভাবে কাজ করছে।

