বাংলাদেশের আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানামুখী অস্থিরতা, অনিয়ম ও আস্থাহীনতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (NBFI) একসময় শিল্প, ব্যবসা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের বিকল্প উৎস হিসেবে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা, অদক্ষ পরিচালনা, রাজনৈতিক প্রভাব, খেলাপি ঋণ ও তদারকির দুর্বলতায় এই খাত আজ ভয়াবহ সংকটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট, এখন আর সময় নেই শুধু সতর্কবার্তা দেওয়ার; কঠোর পদক্ষেপই একমাত্র পথ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে নয়টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের প্রক্রিয়ায় নিয়েছে, যেগুলোর প্রায় সবকটিই খেলাপি ঋণে ডুবে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এতে একদিকে যেমন আমানতকারীদের কষ্টার্জিত অর্থ আটকে গেছে, অন্যদিকে আর্থিক বাজারে আস্থা আরও দুর্বল হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা কেবল কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা নয়; বরং গোটা আর্থিক ব্যবস্থার নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতিফলন। এই প্রেক্ষাপটে জরুরি হয়ে উঠেছে প্রশ্নটি, কেন বারবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধসের মুখে পড়ে, আর কেন তদারকির পরও অনিয়ম রোধ হয় না?
অবসায়নের প্রেক্ষাপট ও কারণ: বাংলাদেশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে নয়টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়ন প্রক্রিয়ায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা আর্থিক দুর্বলতা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও আইনগত পরিবর্তনের সমন্বিত কারণ। এই প্রেক্ষাপটে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, NBFI খাতের অবস্থা আজ বিনিয়োগকারী, আমানতকারী ও অর্থনীতির জন্য উচ্চ ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পোর্টফোলিওর একটি বড় অংশ অবিক্রিয় (non-performing) হয়ে গেছে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুতর তারল্য সংকটে পড়েছে এবং আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতে খেলাপি ঋণের সঙ্কট এখন এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যত দিন যাচ্ছে এই খাতের ঋণ ফেরত না আসার প্রবণতা আরও বাড়ছে। দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি দিন দিন আরও গভীরতর হচ্ছে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি–জুন) খেলাপি ঋণ প্রায় ২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো বর্তমানে ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত দেউলিয়া অবস্থায় রয়েছে। একদিকে গ্রাহকরা তাদের আমানত ফেরত পাচ্ছেন না, অন্যদিকে নতুন ঋণ বিতরণও প্রায় বন্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে এই খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছিল ২৫ হাজার ৭৯ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। সেই হিসাবে ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বিগত সময়ে পুনঃতফসিল আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই খাতেও খেলাপির প্রকৃত চিত্র আড়াল রাখা হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে চেপে রাখা খেলাপি ঋণ এখন প্রকাশ পাচ্ছে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে গ্রাহক আস্থা মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। অনেক আমানতকারী এখন আর টাকা তুলতে পারছেন না।
দেশে বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে ২২টি দেশীয় মালিকানাধীন। ১৩টি দেশি ও বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও টাকা ফেরত দিতে না পারা ২০টি প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করা হবে না- জানতে চেয়ে গত মাসে নোটিশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের পক্ষ থেকেও এতে সায় এসেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও প্রাইম ফাইন্যান্স। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। অন্যদিকে আরও ১৩টি প্রতিষ্ঠানও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যাদের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি।
খেলাপি ঋণের বড় কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জামানতের অভাব। বাংলাদেশের ২০টি প্রধান এনবিএফআই মোট ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে, যার বিপরীতে জামানতের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৭৩ শতাংশই জামানতবিহীন। এটি আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
এই খাতের দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতার পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় থাকা কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া ঋণ প্রদানে স্বচ্ছতার অভাব, পরিচালনা পর্ষদের দুর্বলতা এবং স্বার্থান্বেষী সিদ্ধান্তগুলোর কারণে খেলাপি ঋণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির সীমাবদ্ধতাও সংকটকে আরও জটিল করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধান সত্ত্বেও অনেক সময় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি, যার কারণে ক্ষুদ্র সমস্যা বড় সংকটে পরিণত হয়েছে।
আইনগত দিক থেকেও পরিবর্তন এসেছে। ২০২৩ সালে প্রণীত “ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩”-এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দীর্ঘদিন দায়-পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিল বা অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু NBFI-কে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং যারা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অবসায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
সার্বিকভাবে, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু আর্থিকভাবে দুর্বল নয়; তারা প্রশাসনিক, আইনি ও পরিচালনাগতভাবে টিকে থাকার জন্যও অপর্যাপ্ত। তাই দ্রুত, স্বচ্ছ এবং সুশৃঙ্খল পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া এই সংকটকে কেবল কিছু প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে না, বরং পুরো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
সম্ভাব্য প্রভাব ও ঝুঁকি: নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) অবসায়নের সম্ভাব্য প্রভাব এবং সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকিগুলো যথেষ্ট গভীর এবং বহুমাত্রিক। এসব প্রভাব শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং সামাজিক, বাজার ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত।
প্রথমেই আর্থিক ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করা যায়। অবসায়নের ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমে যেতে পারে, এমনকি ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পায়, যা বাজারে ধীরগতি এবং সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত: কর্মসংস্থান হ্রাস একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব। অবসায়নের কারণে কর্মী ছাঁটাই হতে পারে, যার ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
তৃতীয়ত: বাজার এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব পড়ে। অবসায়নের কারণে সরবরাহকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে এবং নতুন সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যেতে পারে, যা একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি করে এবং খরচ বৃদ্ধি বা মূল্য নির্ধারণে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
চতুর্থত: নিয়ন্ত্রণ ও আইনি ঝুঁকিও থাকে। সরকারি নীতি, আইন বা নিয়মকানুনের পরিবর্তন ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নতুন নিয়ম মেনে চলার জন্য প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হতে পারে, যা ব্যবসার পরিচালনা আরও জটিল করে তোলে।
সংক্ষেপে বলা যায়, অবসায়নের ঝুঁকি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, এটি কর্মসংস্থান হ্রাস, বাজারের অস্থিতিশীলতা, সামাজিক প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিনিয়োগকারীদের জন্য মূলধন হারানোর ঝুঁকি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পর্যন্ত এই খাতের সমস্যা বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে।
অবসায়নের বিচার ও বিশ্লেষণ: অবসায়নের প্রক্রিয়া মূলতঃ একটি কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে আইনি ও নিয়মিত পদ্ধতির মাধ্যমে বন্ধ করার প্রক্রিয়া। এটি শুধুমাত্র আর্থিক দুরবস্থা বা দেউলিয়াত্বের কারণে নয়, বরং কোম্পানির পরিচালনা, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা এবং শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের সুরক্ষা বিবেচনা করে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে অবসায়নের ক্ষেত্রে সাধারণত কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর বিধি অনুযায়ী নির্দিষ্ট আইনি ধাপ অনুসরণ করা হয়।
আদালত বা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের নির্দেশ দিতে পারে। বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক বা এনবিএফআই-এর ক্ষেত্রে সরকার আদালতের মাধ্যমে একজন অবসায়ক নিযুক্ত করে থাকেন, যিনি পুরো অবসায়ন প্রক্রিয়া পরিচালনা ও তদারকি করেন। এই প্রক্রিয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির ঋণ এবং অন্যান্য দায়পরিশোধ নিশ্চিত করতে হয়, যাতে শেয়ারহোল্ডার ও অন্যান্য পাওনাদারদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়।
অবসায়নের বিশ্লেষণ সাধারণত আর্থিক, আইনি ও কার্যকরী দিকগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর্থিক বিশ্লেষণে কোম্পানির সম্পদ ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, নগদ প্রবাহ এবং মূলধনের স্থিতিশীলতা যাচাই করা হয়। আইনি বিশ্লেষণে দেখা হয়, প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানি আইন ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালা মেনে চলেছে কি না। এছাড়া কারণ বিশ্লেষণেও লক্ষ্য রাখা হয়, কোম্পানি তার কার্যক্রম শুরু করেছে কি না, বা নিয়মিতভাবে পরিচালনা করছে কি না। শেয়ারহোল্ডারদের অধিকার ও তাদের পাওনা নির্ধারণও এই বিশ্লেষণের অংশ। আর যদি প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার দেউলিয়াত্বের দিকগুলোও খতিয়ে দেখা হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৯টি NBFI-কে অবসায়নের পথে নেওয়া কঠিন হলেও সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, তথ্যভিত্তিক বিচার এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সর্বাধিক রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। যেসব প্রতিষ্ঠান এখনও কার্যকরভাবে পুনর্গঠন বা একীভূত করার মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের জন্য প্রাক-সতর্কতা ও পুনরুদ্ধারের সুযোগ থাকা উচিত। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও তদারকির ক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে একই ধরনের আর্থিক সংকট এড়ানো সম্ভব হয়। আইন ও নীতিমালা কেবল ঘোষণা করা নয়, কার্যকরভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অবস্থা দীর্ঘদিনের দূর্ব্যবস্থাপনা, স্বার্থান্বেষী প্রশাসন এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অপব্যবহারের ফল। বিশেষভাবে পিকে হালদার গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধি খাতের শৃঙ্খলাকে দীর্ঘমেয়াদি দুরবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই বর্তমান অবসায়ন প্রক্রিয়া শুধুমাত্র আর্থিক পুনর্গঠন নয়, বরং খাতের স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা ও ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য।
প্রতিকারমূলক সুপারিশ ধসে পড়া ৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI)-এর অবসায়নের পর গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেওয়ার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করবে। যদিও এর পরিমাণ এখনও নির্ধারিত হয়নি, তবে সরকারি তহবিল ব্যবহার করে গ্রাহকদের ক্ষতি আংশিকভাবে ক্ষতিপূরণ করা হবে। একই সঙ্গে অবসায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ বিক্রি ও খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে।
ভবিষ্যতের জন্য এটি স্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা আরও শক্তিশালী করতে হবে। খেলাপি ঋণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। এর পাশাপাশি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সমর্থন দেওয়াও প্রয়োজন। অবসায়নের পর গ্রাহক সুরক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। তহবিল ব্যবহার করে গ্রাহকদের জমা অর্থ ফেরত দেওয়া হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ বা ঋণ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বাকি পাওনাগুলো পরিশোধের চেষ্টা করা হবে।
নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থায় সংস্কার আনা অপরিহার্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে NBFI-গুলোর উপর কঠোর নজরদারি চালাতে হবে, যাতে সমস্যা আগে থেকেই চিহ্নিত করা যায়। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তাদের আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী করার সুযোগ দেওয়া হবে এবং ব্যর্থ হলে তাদেরও অবসায়নের আওতায় আনা হবে।
ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করতে হবে। কোনো খাত বা সম্পদ শ্রেণিতে অতিরিক্ত ঋণ প্রদানের কারণে ঝুঁকি বাড়বে, তাই সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপকদের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে কার্যকর ক্ষতিপূরণ স্কিম ও পরিচালন নীতি প্রণয়ন জরুরি। অবসায়নের পরও খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের কাজ চলবে। সম্পদ পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলেও তা চালিয়ে যাওয়া হবে, যাতে সম্ভাব্য সব অর্থ ও সম্পদ পুনরায় সংরক্ষণ করা যায়।
নতুন নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ঋণদাতা হিসেবে শেষ অবলম্বন’ ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। একই সঙ্গে ঋণ মূল্যায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত রোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য আরও শক্তিশালী নিয়মকানুন তৈরি করা হবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, অবসায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে গ্রাহক সুরক্ষা, ঋণ পুনরুদ্ধার, নিয়ন্ত্রক ক্ষমতার জোরদারকরণ এবং নতুন নীতিমালা প্রণয়নকে সমন্বয় করে নেওয়াই দীর্ঘমেয়াদে NBFI খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। এটি শুধু একাধিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন নয়, বরং পুরো আর্থিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) খাতে ধসের ধার প্রান্তে থাকা ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নের পথে নেওয়া কঠিন হলেও সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। এটি শুধু আর্থিক পুনর্গঠন নয়, বরং পুরো খাতের স্বচ্ছতা, স্থিতিশীলতা এবং গ্রাহকের আস্থা রক্ষার জন্য অপরিহার্য। অবসায়নের মাধ্যমে গ্রাহকদের ক্ষতি আংশিকভাবে হলেও কমানো হবে, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যতে এমন সংকট প্রতিরোধের জন্য নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করা হবে।
তবে এটি একমাত্র সমাধান নয়। দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রক তদারকির জোরদারকরণ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিকভাবে, এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে শুধু ৯টি প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং পুরো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের বিশ্বাসযোগ্যতা, স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধি রক্ষা করা সম্ভব হবে। এটি হবে আর্থিক খাতের জন্য সময়োপযোগী, প্রয়োজনীয় এবং দৃষ্টান্তমূলক সংস্কার।