কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়া এলাকা (ইপিজেড) নতুন ইতিহাস গড়েছে রপ্তানিতে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এখান থেকে ৯০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রপ্তানি অর্জন। ইপিজেড কর্তৃপক্ষ আশা করছে, চলতি অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে।
২০০০ সালে ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা ইপিজেডের লক্ষ্য ছিল শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বৃদ্ধি। বর্তমানে এখানে মোট ২৪৩টি প্লট ও ৪৬টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার ১৭টি দেশে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, তাইওয়ান, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য।
বেপজা সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে কুমিল্লা ইপিজেডে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি বেড়েছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৫৬৫.৮৫ মিলিয়ন ডলার, ২০২১–২২ সালে ৮১৪.৮২ মিলিয়ন ডলার, ২০২২–২৩ সালে ৭৯০.৯৪ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩–২৪ সালে ৭১১.৩৭ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৯০১.২২ মিলিয়ন ডলারে। একই সময়ে বিনিয়োগ হয়েছে গড়ে ২৫–৬৭ মিলিয়ন ডলার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুমিল্লা ইপিজেড এখন কর্মচঞ্চল এক শিল্পনগরী। প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করছেন এখানে। কলকারখানার ভেতর মেশিনের শব্দ, শ্রমিকদের ব্যস্ততা আর উৎপাদনের ধারাবাহিকতায় মুখর পুরো এলাকা। এসব শ্রমিকের মধ্যে ৬৬ শতাংশ নারী।
প্রতি মাসে শ্রমিকদের বেতন ও ভাতা বাবদ ব্যয় হয় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এতে স্থানীয় অর্থনীতিও সক্রিয় হয়েছে। আশপাশের দোকান, বাসা ভাড়া ও পরিবহন খাতেও প্রবৃদ্ধি এসেছে।
শ্রমিক সালমা আক্তার বলেন, “ছয় বছর ধরে এখানে কাজ করছি। পরিবেশ ভালো, নিয়মিত বেতন পাই। সংসার ভালোভাবে চলছে।” খাগড়াছড়ির শ্রুতি চাকমা বলেন, “চাকরি করে বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারছি। এটা আমার জন্য গর্বের।”
দেশি শ্রমিকদের পাশাপাশি এখানে ২৮৫ জন বিদেশিও কাজ করছেন, যাদের বেশিরভাগই চীন ও তাইওয়ান থেকে আসা। চীনা শ্রমিক মেবেল বলেন, “বাংলাদেশে কাজের পরিবেশ বেশ নিরাপদ। এখানকার শ্রমিকরা পরিশ্রমী ও উদ্যমী।”
ইপিজেডের কোম্পানিগুলো শ্রমিক কল্যাণেও সচেতন। বেতন-ভাতা সময়মতো দেওয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করা হয়। মার্কিন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পিওয়াই আন্ডারগার্মেন্টসের ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম বলেন, “আমরা শ্রমিকদের কল্যাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওয়ার্কফ্রেন্ডলি পরিবেশ তৈরিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।”
ইপিজেডের কার্যক্রম স্থানীয় অর্থনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলছে। প্রায় সব শ্রমিক আশপাশের এলাকায় বসবাস করছেন। তারা স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে জীবিকা নির্বাহ করছেন, যা কুমিল্লার অর্থনীতিতে নতুন গতি এনেছে।
কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, “২০২৪–২৫ অর্থবছরে কুমিল্লা ইপিজেডে ৯০১.২২ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে, যা একটি রেকর্ড। আমরা শ্রমিকদের কল্যাণে মেডিকেল সেন্টার ও বেপজা স্কুল-কলেজ স্থাপন করেছি। এখানে শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়, আর তাদের সন্তানরা অর্ধেক টিউশন ফিতে পড়াশোনা করতে পারে। এসব উদ্যোগ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।”