নব্বইয়ের দশকের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভোক্তা বাজার ও শ্রমশক্তি এখন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে দেশটির প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বেড়েছে। আর্থিক ও বাজারগত সুবিধা দেখে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন শুধু পুরনো ব্যবসা সম্প্রসারণই নয়, নতুন উদ্যোগেও হাত দিচ্ছে। জাপানি কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক বিনিয়োগকারী এখন পণ্য রপ্তানির পরিবর্তে বাংলাদেশের স্থানীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়াচ্ছেন।
উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে লায়ন করপোরেশন। ২০২২ সালে তারা স্থানীয় কল্লোল গ্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ডিটারজেন্ট উৎপাদন শুরু করেছিল। এখন তারা বাসন মাজা সাবান ও টুথপেস্ট তৈরির জন্য নতুন একটি কারখানা স্থাপন করছে। এছাড়া কিউপি কোম্পানি বাংলাদেশের বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে। দেশজুড়ে রিটেইল চেইনগুলোতে জাপানের প্রসাধনী, সুগন্ধি, খেলনা, ইলেকট্রনিক্স ও স্টেশনারি সহ নানা পণ্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) বাংলাদেশের প্রতিনিধি কাজুয়াকি কাতাওকা বলেন, “সস্তা শ্রম, বিশাল মানবসম্পদ এবং বড় ভোক্তা বাজারের কারণে জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।” তিনি আরও জানান, বর্তমানে দেশে ৩৩০টি জাপানি কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে, যার মধ্যে কেবল অল্প কয়েকটি রপ্তানিমুখী। জেট্রোর ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৫৭.৭ শতাংশ কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
সাম্প্রতিককালে জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (জেবিসিসিআই) ২৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য জাপান সফর করেছে। তারা টোকিও ও ওসাকায় সেমিনারে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে আগ্রহী জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছে। কাতাওকা উল্লেখ করেছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও, গত এক বছরে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানের জন্য নির্ধারিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালু হলে এবং ঢাকা-টোকিওর মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) স্বাক্ষরিত হলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
জেবিসিসিআই সভাপতি তারেক রাফি ভূঁইয়া বলেন, “আমরা ২৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে অত্যন্ত সফল একটি জাপান সফর সম্পন্ন করেছি। টোকিও ও ওসাকায় দুটি বড় সেমিনারের মাধ্যমে দেশের ব্যবসায়িক সুযোগগুলো তুলে ধরেছি।” জেবিসিসিআই মহাসচিব মারিয়া হাওলাদার জানান, জাপানি সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে দেখছে, তবে তারা প্রশাসনিক জটিলতা নিয়ে হতাশ। বিশেষভাবে তারা কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, হালকা প্রকৌশল এবং উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
এক দশক আগে এশিয়ার মধ্যে প্রথম বাংলাদেশি রপ্তানি জাপানে ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছিল। এরপর রপ্তানি প্রায় ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, মূলত বাংলাদেশি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। আগামী বছর নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের পরও এই সুবিধা ধরে রাখার জন্য ঢাকা জাপানের সঙ্গে ইপিএ চুক্তি চূড়ান্ত করার দিকে এগোচ্ছে।
বাংলাদেশের বাজারের সম্ভাবনা ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ দেখেই জাপানি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে।

