গত এক দশকে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের গুদাম ও পণ্যাগারে আটবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো ব্যবসায়ী ক্ষতিপূরণ পাননি। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের পর বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বন্দরে নাশকতার ঝুঁকি এড়াতে প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক। কড়া নজরদারির পাশাপাশি নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিসের একটি প্রতিনিধি দল স্থলবন্দর পরিদর্শন করে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছে।
নিরাপত্তা অপ্রতুল, ঝুঁকিতে কোটি টাকার পণ্য:
দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের অধিকাংশ গুদাম ও ওপেন ইয়ার্ডে অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশেষ করে দাহ্যপণ্য রাখার জন্য আলাদা স্থান না থাকায় সাধারণ পণ্যের সঙ্গেই রাখা হচ্ছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল। এতে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে আগুনে কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায়। এর আগে গত দশ বছরে মোট আটটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রতিবারই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে পুড়ে গেছে বিপুল পরিমাণ আমদানিকৃত পণ্য।
বন্দর সূত্র জানায়, বেনাপোলে মোট ৩৮টি গুদাম ও ওপেন ইয়ার্ড রয়েছে। এগুলোর ধারণক্ষমতা ৪৭ হাজার ৪৪০ টন হলেও সেখানে রাখা হয় দেড় লাখ টনের বেশি পণ্য। ফলে গাদাগাদি করে মাল রাখার কারণে অগ্নিঝুঁকি আরও বেড়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক গুদামে ড্রামভর্তি রঙ, রেইজিং পাউডার, ছাপাখানার কালি ও মোটরগাড়ির ইঞ্জিন তেলের মতো দাহ্যপণ্য সাধারণ মালামালের পাশে রাখা হয়েছে। যদিও গুদামের পাশে এক্সটিংগুইশার রাখা আছে, তবু তা যথেষ্ট নয়।
২০১৬ সালের ২ অক্টোবর বন্দরের ২৩ নম্বর গুদামে ভয়াবহ আগুনে কোটি কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায়। তৈরি পোশাক, কাপড়, রাসায়নিক দ্রব্য, মোটরযন্ত্রাংশ, ফাইবার, তুলা ও স্প্রে—সবই আগুনে ধ্বংস হয়। তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তিন বছরেও ব্যবসায়ীরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
বেনাপোল আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘বন্দরের প্রতিটি গুদামই ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো ও নজরদারি জোরদার করা জরুরি। এখানে নাশকতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
বেনাপোল সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা বাড়াতে হবে। দাহ্যপণ্য আলাদা স্থানে রাখতে হবে। নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।’
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘পূর্বের অগ্নিকাণ্ডে বহু ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। গুদামগুলোর কোনো পণ্যের বীমা নেই। অথচ ব্যবসায়ীরা নিয়মিত রাজস্ব ও ভাড়া দিচ্ছেন। তাদের পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।’ তিনি পুরো বন্দর এলাকাকে সিসিটিভির আওতায় আনার আহ্বান জানান।
বেনাপোল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তা বায়োজিদ বোস্তামি বলেন, ‘বন্দরের অগ্নিনিরাপত্তা এখনো অপ্রতুল। আমরা দাহ্য পদার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছি।’
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামিম হোসেন রেজা বলেন, ‘প্রতিটি গুদামে ফায়ার হাইড্রেন্ট পয়েন্ট ও পাম্প রয়েছে। তবে অগ্নিঝুঁকি পুরোপুরি নেই, তা বলা যাবে না। নাশকতার আশঙ্কা রোধে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।’

