একসময় ব্যাংকিং মানেই ছিল দীর্ঘ লাইন, অপেক্ষা আর সময়ের অপচয়। টাকা জমা দেওয়া থেকে শুরু করে হিসাব খোলা বা বিল পরিশোধ—সব কাজেই যেতে হতো ব্যাংকের শাখায়। এখন সেই দিন অতীত। প্রযুক্তির দৌলতে ব্যাংকিং চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। স্মার্টফোনে কয়েকটা ট্যাপেই এখন খোলা যায় হিসাব, পাঠানো যায় টাকা, এমনকি নেওয়া যায় ঋণও।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যাংক এখন নিজস্ব মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে, যেখানে প্রায় সব ধরনের সেবা পাওয়া যায়। এতে গ্রাহকেরা যেমন স্বস্তি পাচ্ছেন, তেমনি ব্যাংকগুলোর পরিচালন খরচও কমছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। কিছু ব্যাংকে গ্রাহক ও লেনদেনের প্রবৃদ্ধি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নেক্সাস পে, ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা, এবং সিটি ব্যাংকের সিটিটাচ—এই চারটি অ্যাপ এখন দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মূল চালিকাশক্তি।
শীর্ষে রয়েছে নেক্সাস পে। ২০১৮ সালে চালু হওয়া এই অ্যাপ এখন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংকের ভিসা ও মাস্টারকার্ডধারীদের জন্যও উন্মুক্ত। ব্যাংকটির এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন জানান, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেক্সাস পের ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছে ৮৬ লাখে, যেখানে এক বছর আগেও ছিল ৭১ লাখের কিছু বেশি। একই সময়ে লেনদেন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
২০২০ সালের নভেম্বরে ইসলামী ব্যাংক তাদের অ্যাপ সেলফিন চালু করে। মাত্র তিন বছরে এটির ব্যবহারকারী বেড়ে ৫৬ লাখে পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা—যা জানুয়ারির তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
অন্যদিকে, ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা অ্যাপ ২০২১ সালে যাত্রা শুরু করে। এখন এর ব্যবহারকারী ১১ লাখের বেশি, এবং সেপ্টেম্বরে লেনদেন ছুঁয়েছে ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
২০১৫ সালে চালু হওয়া সিটিটাচ অ্যাপেও এখন নতুন গতি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যবহারকারী ছিল ৬ লাখ, যা এক বছরে বেড়ে ৯ লাখে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনের অঙ্কও বেড়ে ১১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
প্রাইম ব্যাংকের অ্যাপ মাই প্রাইম-এ এখন পাওয়া যাচ্ছে বাংলা ভাষায় লেনদেনের সুবিধা, ইসলামি ও এসএমই ব্যাংকিং সেবা, এমনকি ঋণের আবেদনও। ব্যাংকের ডেপুটি এমডি নাজিম এ. চৌধুরীর ভাষায়, “নতুন ফিচার যুক্ত করার ফলে এক বছরে আমাদের গ্রাহক ও লেনদেন ৩০০ শতাংশ বেড়েছে।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নিও অ্যাপেও এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ছোঁয়া। বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ ব্যবহারকারী এই অ্যাপ ব্যবহার করছেন, যেখানে রয়েছে ২০০টিরও বেশি সেবা। ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা চাই তরুণ প্রজন্ম ঘরে বসেই ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতা উপভোগ করুক—বিনা ঝামেলায়, নিরাপদে।”
অবশ্য এখনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক লেনদেন বা বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত কাজের জন্য অনেককেই ব্যাংকে যেতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, এই সেবাগুলোও যদি অ্যাপে যুক্ত করা যায়, তবে ডিজিটাল ব্যাংকিং আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
বর্তমানে ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে করা যাচ্ছে সঞ্চয়ী ও স্থায়ী হিসাব খোলা, বিল পরিশোধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন জমা, কর প্রদান, বিমা প্রিমিয়াম পরিশোধসহ অসংখ্য সেবা।
পূর্ণাঙ্গ অনলাইন ব্যাংকিং এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয়তা। শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় গ্রাহকেরা মোবাইলের মাধ্যমেই পাচ্ছেন নিরাপদ ব্যাংকিংয়ের স্বাদ।
যেভাবে প্রযুক্তি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঢেউ তুলছে, তাতে ভবিষ্যতের ব্যাংক হয়তো থাকবে আমাদের হাতের পর্দায়ই—নগদহীন, শাখাবিহীন, তবু সবার নাগালে।

