দেশের পেঁয়াজের বাজারে ফের অস্থিরতা। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। রাজধানীর বাজারে এখন দেশি ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। আমদানিকারকরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। তাদের দাবি, ভারী বৃষ্টিতে নতুন পেঁয়াজের চারা নষ্ট হওয়ায় বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাজারসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন— এটি সরবরাহের সমস্যা নয়, বরং একটি পরিকল্পিত “সিন্ডিকেট খেলা”।
টিসিবির তথ্য বলছে, এক মাসে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ। অথচ সরকারি হিসাবে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় উৎপাদন পর্যাপ্ত, এখনই আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি পেলেই দুই দিনের মধ্যে দাম অর্ধেকে নেমে আসবে।
রাজধানীর মালিবাগ, কারওয়ান বাজার ও আগারগাঁও ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক দিন আগেও যেখানে দেশি পেঁয়াজ ছিল ৮০ টাকা, এখন তা ১২০ টাকায় পৌঁছেছে। এক সপ্তাহেই প্রায় ৪০ টাকার পার্থক্য। পাইকারি বাজারেও একই চিত্র— মোকাম থেকে দাম বেড়ে আসছে প্রতিদিন।
শ্যামবাজারের এক বড় ব্যবসায়ী বললেন, “দৈনিক চাহিদা ছয়-সাত হাজার টন। কিন্তু এখন যেটুকু আছে তা দিয়ে সেই চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। নতুন পেঁয়াজ আসতে সময় লাগবে দেড়-দুই মাস।”
কৃষি মন্ত্রণালয় অবশ্য এখনই আমদানির অনুমতি দিতে নারাজ। তাদের যুক্তি, শিগগিরই দেশীয় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাজারে আসবে, এখন আমদানি খুললে কৃষকেরা দাম পাবেন না। তবে মন্ত্রণালয়ের ভেতর থেকেই জানা গেছে, দুই হাজার ৮০০টির বেশি আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) আবেদন ইতোমধ্যে জমা পড়েছে। অনেকে আবার অনুমতি ছাড়াই এলসি খুলে পেঁয়াজ বন্দরে এনে সরকারকে চাপে ফেলছেন।
সূত্র বলছে, ভারতের কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে কাগজে কেজিপ্রতি ২০ রুপির পেঁয়াজ ৩০ রুপি দেখিয়ে টাকা পাচারের পথও তৈরি করছে। এদিকে আইপি না দেওয়ার বিরুদ্ধে করা ১৪টি রিটও হাইকোর্ট খারিজ করেছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন মনে করেন, এটি স্পষ্টতই ব্যবসায়ীদের কারসাজি। “নির্বাচনের সময়ে সরকারের নজর অন্যদিকে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা দেখা দিয়েছে, আর ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে পকেট কাটছে,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করেন, দামের এই উল্লম্ফন সম্পূর্ণ ‘সিন্ডিকেটের খেলা’। তাদের ভাষায়, “বিগত ১৫ বছর ধরে যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, তারাই আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।”
পাবনার চাটমোহরের কৃষক রণজিৎ চন্দ্র দাশ বলেন, “আমাদের প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ ৪০ টাকা। এখন যদি ভারতীয় পেঁয়াজ ঢুকে পড়ে, আমাদের সব শেষ। আমরা চাই সরকার অন্তত মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমদানি বন্ধ রাখুক।”
কৃষি সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ বলেন, সরকার ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে— যেন কৃষকও বাঁচে, ভোক্তাও স্বস্তিতে থাকে। “আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে আছি। কৃষকদের উন্নত বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে, পেঁয়াজ সংরক্ষণে ৮ হাজার এয়ার ফ্লো মেশিন বসানো হয়েছে,” তিনি জানান।
এখন প্রশ্ন—সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পেঁয়াজের বাজারে আগুন কেন? উত্তর খুঁজে পেতে হলে নজর দিতে হবে সেই পুরনো গল্পে— মজুতদার, সিন্ডিকেট আর রাজনৈতিক সময়ের সুযোগ নেওয়া ব্যবসায়ীদের দিকে।

