বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য ও ব্যাংকিং খাতের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবরে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশের বেশি কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি অর্থনীতিতে আমদানির চাহিদা হ্রাস এবং নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতার প্রতিফলন।
২০২৫ সালের অক্টোবরে ৫.৬৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা ২০২৪ সালের একই মাসে ছিল ৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এলসি খোলার হার কমেছে ১২.১৫ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬.৩১ বিলিয়ন ডলার। এলসি নিষ্পত্তির হারও আগের বছরের তুলনায় ১১.৪৮ শতাংশ কমেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে এলসি বিল পরিশোধ করা হয়েছিল ৬.১০ বিলিয়ন ডলারে, যা এ বছরের অক্টোবরে কমে ৫.৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এলসি খোলার হ্রাসের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। অনেক আমদানিকারক রমজানের ভোগ্যপণ্যের জন্য বছরের শুরুতেই এলসি খুলে রেখেছেন। তাই অক্টোবরে চাপ বেশি ছিল না। এছাড়া শীতের আগে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির চাহিদাও কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতার হোসেন বলেন, “রোজার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আগেই আমদানি করা হয়েছে। দেশেও পণ্যের সরবরাহ যথেষ্ট ছিল। তাই অক্টোবরে এলসি খোলার চাপ কম ছিল। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে, কোন সংকট বা দামের অস্থিরতা নেই।”
মিডল্যান্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আহসান-উজ জামানও বলেন, “রোজার জন্য আমদানি আগেই হয়েছে, তাই অক্টোবরে কিছুটা কম হয়েছে। সবসময় বেশি এলসি খোলা হয় না। মাঝে মাঝে সরকারি বড় এলসি খোলা হয়।”
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ট্রেজারি কর্মকর্তা বলেন, “সরকারি এলসি খোলা আগের মতোই আছে। তবে বেসরকারি খাতের এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি বেশি হয়নি। এলএনজি আমদানি শীতের আগে কম হয়। তাই এই মাসে এলসি খোলা কমেছে।” পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানির এলসি খোলা কম থাকবে। সেপ্টেম্বরেও এলএনজি আমদানি কম হয়েছিল।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করছেন, সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নতুন বিনিয়োগও কমেছে। ড. আখতার হোসেন বলেন, “নতুন বিনিয়োগ কম হওয়ায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। তাই এলসি খোলার হার কমেছে।” আহসান-উজ জামান বলেন, “সামনের দিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে বিনিয়োগ বাড়বে। তখন অর্থনীতিও ভালো হবে।” একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানও বলেন, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে বিনিয়োগ ও এলসি খোলা বাড়বে। বর্তমানে অনেক বড় গ্রুপের এলসি খোলা কমেছে। নির্বাচনের পর প্রতিষ্ঠানগুলো আবার এলসি খোলা শুরু করবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে নিট ইক্যুইটি (নতুন বিনিয়োগ) দাঁড়িয়েছে ৮১ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের একই প্রান্তিকে ছিল ২১৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ৬২ শতাংশ কম। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৬.২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। নতুন বিনিয়োগ কমলে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, “বাণিজ্য লেনদেনে কড়া নজরদারির কারণে এলসি খোলা কমেছে। আগে বেশি এলসি খোলা হতো, কিন্তু তার পেছনে অর্থ পাচারও ছিল। এখন ওভার ইনভয়েসিং বন্ধ হয়েছে। অবৈধ লেনদেনের সুযোগ কমে যাওয়ায় এলসি খোলার হারও কমেছে।”

