চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আগস্ট থেকে দেশের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশ। প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকে হ্রাসের হার আরও বেশি। আয় কমার সঙ্গে ক্রেতাদের অর্ডারও কমেছে।
অক্টোবে রপ্তানি আদেশ কমেছে আগের মাসের তুলনায় ২০ শতাংশ। আদেশ কমে এসেছে ৩৯ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় চার হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা (এক ডলার = ১২২ টাকা)। সাধারণত আদেশ পাওয়ার পর পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। আদেশ কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে রপ্তানি খাত আরও সংকটে পড়তে পারে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, আদেশ কমার মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক। বাংলাদেশের পণ্যে ২০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম হলেও রপ্তানি খাত চাঙ্গা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের কারণে চীন ও ভারত বিকল্প বাজার হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকেছে। চীন ইইউতে স্বাভাবিকের চেয়ে কম দরে পণ্য রপ্তানি করছে। অপ্রচলিত বাজারেও বাংলাদেশ ভালো করতে পারছে না। এসব বাজারে প্রতিযোগীরা বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কম।
পোশাক খাতের তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়-সংক্রান্ত প্ল্যাটফর্ম অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১০ বছরে ইইউর ২৭ দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। একই সময়ে চীনের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান কার্যালয় ইউরোস্ট্যাট জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ, পরিমাণ ১৩.৪৮ বিলিয়ন ইউরো। একই সময়ে চীনের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ, যা ১৭ বিলিয়ন ইউরোর বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগস্ট মাসে রপ্তানি কমেছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১১ কোটি ডলার। রপ্তানির পরিমাণ নেমে এসেছে ৩৯২ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের আগস্টে ৪০৩ কোটি ডলার ছিল। পোশাক রপ্তানি কমে দাঁড়িয়েছে ৩১৭ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের আগস্টে ৩৩৩ কোটি ডলার ছিল।
সেপ্টেম্বরে রপ্তানি হয়েছে ৩৬৩ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই মাসে ৩৮০ কোটি ডলার ছিল। পোশাক রপ্তানি কমে ১৭ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে ২৮৪ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ৩০১ কোটি ডলার। অক্টোবে রপ্তানি কমেছে ৫১ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি কমে ২৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩০২ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ৩৩০ কোটি ডলার।
অক্টোবে পোশাক রপ্তানি আদেশ কমেছে ৩৯ কোটি ডলারের:
রপ্তানি আদেশের পরিস্থিতি বোঝা যায় ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন বা ইউডি-এর মাধ্যমে। রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর কারখানাগুলো পোশাক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি করে। আদেশে উল্লিখিত পোশাকের পরিমাণ অনুযায়ী কাঁচামালের প্রয়োজনের সনদই হলো ইউডি। এই সনদ সরকার দুইটি সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ-এর মাধ্যমে দেয়। দুই সংগঠন থেকে সংগ্রহ করা ইউডির তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে রপ্তানি আদেশ কমেছে ৩৯ কোটি ডলার। অক্টোবরের মোট আদেশ ছিল ২২০ কোটি ডলার, যেখানে সেপ্টেম্বরে ছিল ২৪৫ কোটি ডলার।
ঢাকা অঞ্চলের কারখানার রপ্তানি আদেশ অক্টোবর মাসে আগের মাসের তুলনায় ১৫ শতাংশ কমে ২১০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এটি আগের মাসের তুলনায় ৩৫ কোটি ডলার কম। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কারখানার আদেশ আরও বেশি হ্রাস পেয়ে ২৬ শতাংশ কমে এসেছে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে। সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের আদেশ ছিল ১৪ কোটি ডলার।
রপ্তানি কমার পেছনে চীনের আগ্রাসী রপ্তানি ও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক:
বিজিএমইএ-এর পরিচালক ও হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম শামসুদ্দিন বলেন, পোশাক রপ্তানি কমার মূল কারণ হচ্ছে চীনের আগ্রাসী রপ্তানি, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অতিরিক্ত শুল্কের কারণে চীন কম দামে পণ্য ইইউতে পাঠাচ্ছে। এতে বাংলাদেশে রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, তৈরি পোশাকের দুই ধরনের পণ্য থাকে। একটি হলো নেভার আউট অব স্টক (এনওএস) এবং অন্যটি ফ্যাশন পণ্য। এনওএস পণ্য সারা বছর বিক্রি হয়। চীনের জন্য এই পণ্যে দর কমিয়ে বাজার দখল করা সহজ, কারণ তাদের সব ধরনের কাঁচামাল ও লিড টাইমের সুবিধা রয়েছে। লিড টাইম হলো রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়। উৎপাদনশীলতার কারণে চীন এগিয়ে আছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট মহিউদ্দিন রুবেল জানান, রপ্তানি আদেশ কমার এক বড় কারণ মার্কিন শুল্ক। অস্বাভাবিক হারে বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে পরিবর্তন এসেছে। ভারতসহ কিছু দেশের সঙ্গে এখনও আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থিতিশীলতা এখনও ফিরেনি। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে সেখানে পোশাকের দর বেড়েছে এবং চাহিদা কমেছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। চীন ও ভারতীয় রপ্তানিকারকরা বুঝতে পেরেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত শুল্কের কারণে তাদের পণ্য সহজে রপ্তানি করা যাবে না। তাই তারা ইইউ এবং অপ্রচলিত বাজারে আগ্রাসী রপ্তানি বাণিজ্য চালাচ্ছে।
কোন বাজারে কী অবস্থা:
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের পোশাকের প্রচলিত বাজার। ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি মাত্র ৩ শতাংশ বেড়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এটি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। রপ্তানিকারকরা ধারণা করছেন, অক্টোবরে একক মাসে ইইউতে রপ্তানি আরও কমেছে।
অন্যদিকে, অপ্রচলিত বাজারে প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম, মাত্র ০.৭৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এটি প্রায় ৫ শতাংশ ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রে একই সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশ।

