দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ের ব্যস্ত সড়কে কল্যাণ জুয়েলার্স ইন্ডিয়ার মূল বিক্রয়কেন্দ্র বিস্তৃত ১ হাজার ৮৬০ বর্গমিটারের। প্রতিদিনই এখানে ভিড় লেগেই থাকে। ত্রিশোর্ধ্ব দম্পতি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রফেরত ভারতীয় প্রবাসীরা এখানে ঝকঝকে সোনার নেকলেস, চুড়ি, কানের দুল ও আংটির বিপুল সংগ্রহ দেখতে আসেন।
বিক্রয়কর্মীরাও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী অলংকার দেখাতে ব্যস্ত থাকেন। সাধারণ সোনার আংটির দাম ২০০ ডলারের নিচে হলেও হীরক, রুবি ও পান্নায় খচিত বিয়ের গয়নার দাম ৬০ হাজার ডলার পর্যন্ত। বিশেষ তালাবদ্ধ কাচের শোকেসে রাখা রাজকীয় অলংকারের কিছু সেটের দাম ১ লাখ ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত পৌঁছে।
সোনার প্রতি ভারতীয়দের আকর্ষণ যুগান্তকারী। দেশটির পরিবারগুলোর হাতে মজুত আছে ৩৪ হাজার ৬০০ টন সোনা, যার মূল্য প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার, মরগান স্ট্যানলির হিসাব অনুযায়ী। এই বিশাল বাজারে কল্যাণ এখন দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম খুচরা গয়না বিক্রেতা। সম্প্রতি কয়েক বছরে কোম্পানিটির বিক্রি বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। খাঁটি সোনার নিশ্চয়তা দেওয়াই তাদের ব্যবসার মূল শক্তি। ওয়ারবার্গ পিনকাসের মতো ইকুইটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগও তারা পেয়ে গেছে।
বিয়ের গয়না বিক্রিতে কল্যাণের খ্যাতি দেশজুড়ে। গত পাঁচ বছরে আয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার। কর-পরবর্তী মুনাফা বেড়েছে পাঁচ গুণ। তবে বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৪ হাজার ডলার স্পর্শ করায় বিক্রিতে সামান্য ভাটা পড়েছে। গয়না বিক্রেতাদের সামনে এটি নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে কল্যাণের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৭৮ বছর বয়সী শতকোটিপতি টি এস কল্যাণারমণ (নিট সম্পদ ৩১০ কোটি ডলার), উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, “চাহিদা বৃদ্ধির শেষ নেই।”
দুই ছেলে রাজেশ (৫০) ও রমেশ (৪৮) বাবার সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত। তাঁদের সহযোগিতায় কল্যাণারমণ দেশে প্রায় ৪০০ দোকান এবং মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে আরও ৪০টি শোরুম তৈরি করেছেন। সোনার দাম বাড়ায় কোম্পানি এখন বাজেটবান্ধব ও হালকা ওজনের অলংকারে জোর দিচ্ছে। বাজারের পরিবর্তন বুঝে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা তাদের মূল শক্তি। মুম্বাইয়ে তাদের ডিজাইন টিম এবং দেশে ৯০০ উৎপাদনকারী রয়েছে।
আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজের গবেষণাপ্রধান মনোজ মেনন মনে করেন, এই উদ্যোগের ফলে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অনেকটা মোকাবিলা করা যায়। তাদের পূর্বাভাস, আগামী দুই বছরে কল্যাণের আয় ২৮ শতাংশ এবং কর-পরবর্তী মুনাফা ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিয়ের অলংকারের বাজারে কল্যাণের আধিপত্য:
কল্যাণ জুয়েলার্সের মোট বিক্রির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বিয়ের অলংকার থেকে। এই গয়নার নকশায় স্পষ্টভাবে দেখা যায় হিন্দুধর্মীয় প্রভাব—মন্দিরের নকশা, দেবী লক্ষ্মী ও গণেশসহ বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর অলংকরণ এবং ধর্মীয় মোটিফ। ভারতীয় পরিবারে মেয়েদের উপহার হিসেবে সোনার গয়না দেওয়া প্রাচীন রীতি। সোনা ‘স্ত্রীধনের অংশ’; এটি আইনে নারীর একান্ত সম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃত এবং স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি থেকে এর ওপর কোনো দাবি করা যায় না। বিয়ে ছাড়া অক্ষয় তৃতীয়া ও দীপাবলির মতো উৎসবেও সোনা কেনা শুভ—এটিই ভারতীয় রীতি।
ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে সোনার যোগ অত্যন্ত গভীর। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশটির সোনার বাজার দীর্ঘমেয়াদি চাঙা থাকবে। গবেষণা সংস্থা নোমুরার মতে, বর্তমানে ৯ হাজার কোটি ডলারের এই বাজার আগামী ৮ বছরে ১৫ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। বর্তমানে ভারতের পরিবারের একাধিক সদস্য আয় করছেন। সেই সঙ্গে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। তাঁরা কল্যাণের বিয়ের অলংকারের ভবিষ্যৎ ক্রেতা। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩৯ কোটি হতে পারে।
কল্যাণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:
ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে কল্যাণারমণ ব্যবসা সম্প্রসারণে গতি আনছেন। চলতি অর্থবছরে আরও ৯০টি দোকান খোলার পরিকল্পনা তাঁর। গত কয়েকটি ত্রৈমাসিকে বিক্রিতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। সম্প্রসারণের বড় অংশ আসবে ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল থেকে।
তিন বছর আগে পশ্চিম ভারতের আওরঙ্গবাদে কল্যাণ প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি-স্বত্বভোগী কিন্তু কোম্পানি পরিচালিত দোকান খোলেন। এখন অর্ধেকের বেশি দোকানই ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকানাধীন। আরও অনেক কোম্পানি–মালিকানাধীন দোকানও ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে দেওয়া হবে। জুন মাসে শেষ ত্রৈমাসিকে কল্যাণের মোট আয়ের ৪৩ শতাংশ এসেছে ফ্র্যাঞ্চাইজির দোকান থেকে।
আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজের মনোজ মেনন বলেন, “ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের ব্যবসার জটিলতা সামলানো সহজ। সবকিছু নিজে করলে বড় হওয়া সম্ভব নয়।” বিদেশেও ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে কল্যাণের। আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও ওমানে তাদের ৩৮টি দোকান এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২টি দোকান আছে। সর্বশেষ ত্রৈমাসিকে মোট আয়ের প্রায় ১২ শতাংশ এসেছে এসব আন্তর্জাতিক দোকান থেকে। নিউ জার্সির আইসেলিন ও শিকাগোর পর এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে আরও দুটি দোকান খোলা হবে। ইউরোপেও পা বাড়িয়েছে কোম্পানি। অক্টোবরে যুক্তরাজ্যে একটি দোকান চালু করেছে তারা।
দেশের বাজারে নতুন গ্রাহক টানতে বিজ্ঞাপনে জোর দিচ্ছে কল্যাণ। গত ৪ বছরে বিজ্ঞাপনে খরচ হয়েছে ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপি। বলিউড তারকা ক্যাটরিনা কাইফ, জাহ্নবী কাপুর, দক্ষিণি সুপারস্টার নাগার্জুন ও প্রভু গণেশন—সকলেই তাদের মডেল হয়েছেন।

