বাংলাদেশ বিশ্বের ২২৬ দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করে। তবে সব মহাদেশে এ বাণিজ্য সমান নয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রপ্তানিতে সাফল্যের ওপর ভর করে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে এগিয়ে থাকলেও এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় দেশটি এখনো বাণিজ্যঘাটতির মুখে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ অর্থবছর ২০২৪–২৫ এ ১২২ দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল। কিন্তু ১০৪ দেশের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতিতে পড়ে দেশের অবস্থান। ঘাটতি এতটাই বেশি যে এগিয়ে থাকা ১২২ দেশের হিসাবেও বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এনবিআরের হিসাব দেখায়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ২০১ দেশের সঙ্গে ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে ২০৬ দেশ থেকে আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি ডলারের পণ্য। এর ফলে অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৭ কোটি ডলার। মোট আকারে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ হাজার ৪০২ কোটি ডলার।
এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে:
বিশ্বের বৃহৎ ভোক্তা বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। গত অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৬২৬ কোটি ডলারে, যা অন্য কোনো দেশের চেয়ে বেশি। চার দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে কোটাসুবিধা দিয়েছিল। সেই সুযোগ নিয়েই রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র একক বাজার হিসেবে বাংলাদেশের পণ্যের বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। পাল্টা শুল্ক আরোপের পরও বাংলাদেশ এখানে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও উত্তর আমেরিকার কানাডা, মেক্সিকো, পানামার মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি আমদানির তুলনায় বেশি। গত অর্থবছরে এই মহাদেশের ২৫টি দেশ ও অঞ্চলে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। বিপরীতে আমদানি হয়েছে ৩৪৮ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে ৭১৯ কোটি ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হয়েছে বাংলাদেশের।
পোশাকে ভর করে এগিয়ে ইউরোপেও:
ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যেও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এই মহাদেশের দেশগুলো থেকে আমদানি তুলনামূলকভাবে কম, আর রপ্তানি বেশি। বিশেষত বাংলাদেশের পোশাক ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় বাজার। মূলত এই পণ্য দিয়েই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।
গত অর্থবছরে ইউরোপের ৫১টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৬৭৬ কোটি ডলারের পণ্য। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৫১০ কোটি ডলারের। এর ফলে ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৬ কোটি ডলার। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। গত অর্থবছরে জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে ৫৩২ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি হয়েছে ৮২ কোটি ডলারের। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার। জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন ও বেলজিয়ামের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।
বড় ঘাটতি চীন ও ভারতে:
এশিয়া মহাদেশে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘাটতি চীনের সঙ্গে। গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৬১ কোটি ডলারের পণ্য। বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলারে।
চীনের পরই বড় ঘাটতি ভারতের সঙ্গে। যদিও প্রতিবেশী দেশটিতে রপ্তানি বাড়ছে, তবুও ঘাটতি কমতে সময় লাগছে। গত অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৯৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, আর রপ্তানি হয়েছে ১৮২ কোটি ডলারের। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৮৬ কোটি ডলারে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চীন ও ভারত থেকে বেশি আমদানি হলেও তা ইউরোপ ও আমেরিকায় রপ্তানিতে ভূমিকা রাখছে। কারণ, এই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল বেশি আমদানি করে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চীন থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ৫৪ শতাংশ রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল। বাকি ৪৬ শতাংশ ছিল বাণিজ্যিক পণ্য। ভারতের ক্ষেত্রে ৩১ শতাংশ আমদানি কাঁচামাল, বাকিটা বাণিজ্যিক পণ্য। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে কম সময়ে ও খরচে পণ্য আনা যায়। চীনের কাঁচামাল ছাড়াও ইলেকট্রনিক ও বাণিজ্যিক পণ্যের বড় উৎস। ফলে দেশীয় ভোক্তারা কম খরচে উপকৃত হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেও বাংলাদেশ বেশি আমদানি করছে, রপ্তানি তুলনায় কম। এভাবে এশিয়ার ৫১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চলছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের এশিয়া বাণিজ্যের অংশ দাঁড়িয়েছে মোট দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো দেশের সঙ্গে ঘাটতি থাকবে, অন্যের সঙ্গে উদ্বৃত্ত। তবে মূল লক্ষ্য হলো মোট বৈদেশিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত নিশ্চিত করা।
ক্ষুদ্র বাজার, তবু বড় ঘাটতি:
দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে থেকে আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। মূলত সয়াবিন তেল, সয়াবিন বীজ ও গমসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানি করা হয়। গত অর্থবছরে এই দেশগুলো থেকে ৩৮৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, রপ্তানি হয়েছে ৬০ কোটি ডলারের। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩২৯ কোটি ডলারে।
আফ্রিকার দেশগুলোতেও একই চিত্র। আমদানি হয়েছে ২৮১ কোটি ডলারের পণ্য, রপ্তানি মাত্র ৪৪ কোটি ডলারের। দ্বিপক্ষীয় ঘাটতি ২৩৭ কোটি ডলারে। ওশেনিয়ার দেশগুলোতে গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১০৩ কোটি ডলারের পণ্য, আমদানি হয়েছে ১৮৫ কোটি ডলারের। বাণিজ্যঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৩ কোটি ডলারে। আমিরুল হক, এমডি, সিকম গ্রুপ, মনে করেন, “নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হলে শিল্প গড়ে উঠবে। রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি কমানো সম্ভব।”
আমদানি বেশি, রপ্তানি কম হওয়ার কারণ:
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে শিল্পের কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত পণ্যে আমদানির ওপর নির্ভরতা বেশি। কয়েকটি প্রতিস্থাপক কারখানা ছাড়া বাকি শিল্পের কার্যক্রম ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে আমদানির নির্ভরতাও কমছে না। রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের পরিমাণ সীমিত। প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য রপ্তানিতে কোনো অগ্রগতি নেই। গত অর্থবছরে রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯৪৭ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য মোট রপ্তানির মাত্র ২ শতাংশ বা ১১৩ কোটি ডলারের মতো। অন্য কোনো খাতের রপ্তানি আয় বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেনি। আমদানি বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশমুখী পণ্যে পরিবহনভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি, যা মূলত আমদানিকারক পরিশোধ করেন। আর রপ্তানি কম হওয়ায় রপ্তানিতে পরিবহনভাড়া কম, যা বিদেশি ক্রেতারা বহন করেন।
ঘাটতি কমাতে যা করণীয়:
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো দেশের সঙ্গে ঘাটতি থাকবে, অন্যের সঙ্গে উদ্বৃত্ত থাকবে। তবে মোট বৈদেশিক বাণিজ্য যাতে উদ্বৃত্ত থাকে, সেই চেষ্টা থাকা দরকার। এজন্য বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও যোগাযোগের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এতে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। মানবতন্তু দিয়ে তৈরি পোশাকের বৈচিত্র বাড়ানো প্রয়োজন, পাশাপাশি বহুমুখী পণ্যের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণও জরুরি।”
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, “দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও আসিয়ানের দেশগুলো থেকে আমাদের আমদানি ৬০ শতাংশের বেশি। কিন্তু রপ্তানি ১২ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এসব দেশ বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। তাই আমাদের রপ্তানি বাড়াতে নজর দিতে হবে। তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্যে আমরা উদ্বৃত্ত অবস্থায় থাকব।”
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, “দুটি বিষয় জরুরি। এক, সরকারি বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাণিজ্যে সমঝোতার দক্ষতা। যেসব দেশের সঙ্গে আমদানি বেশি, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। যেমন ভারতের সঙ্গে শুল্ক–অশুল্ক বাধা আছে, ভিসা পাওয়া যায় না। তাহলে রপ্তানি বাড়বে কীভাবে? দুই, সহায়তা নয়, উদ্যোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ হলে শিল্প গড়ে উঠবে, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি কমানো সম্ভব।”

