দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলাজট কোনোভাবেই কমছে না। বরং প্রতি বছরই নতুন মামলা যুক্ত হওয়ায় এ সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠছে। সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। ২০২৪ সালে আদালতে মামলাজট বেড়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৪টি। যার মধ্যে শুধু শেষ ছয় মাসেই যুক্ত হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৬৪১টি মামলা। সব মিলিয়ে দেশের আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি, যা গত এক যুগে সর্বোচ্চ।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে মামলাজট বেড়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মামলার জট দেখা যাচ্ছে আপিল বিভাগে, যেখানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ হাজার ১২০টি। গত ছয় মাসে এ সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৬৪৩টি। সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার সময় বিচারাধীন মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৭টি। অর্থাৎ, গত দেড় দশকে মামলাজট তিনগুণ বেড়েছে।
বিচারব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার ২০২৪ সালের আগস্টে বিচারক নিয়োগসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে অধ্যাদেশ জারি করে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আইন কর্মকর্তা বদল করা হয়। এরপরও মামলার জট কমার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।
২০১৬ সাল থেকে মামলাজট নিয়ন্ত্রণে এলেও ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা দায়েরকৃত মামলার তুলনায় বেশি হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসে। হাইকোর্টে নিয়োগ পান ২৩ জন বিচারপতি, অধস্তন আদালতেও ব্যাপক রদবদল হয়।
সরকার মামলাজট কমানোর লক্ষ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে। ৮ ফেব্রুয়ারি কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয়, যেখানে মামলার জট নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, “মামলাজট বাড়তে থাকলে বিচারপ্রার্থীরা আরও বেশি দুর্ভোগে পড়বেন। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সংকট নিরসন করতে হবে। আপাতত, আপিল বিভাগের বিচারপতি সংখ্যা দ্বিগুণ করাই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে।”
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার মতে, “লঘু অপরাধ ও অর্থদণ্ডের মতো মামলাগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে সংকট আরও বাড়বে।”
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, “বিচারক সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বার ও বেঞ্চের সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে। পুরোনো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”
বর্তমানে উচ্চ আদালতে ৯৯ জন বিচারপতি রয়েছেন, এর মধ্যে আপিল বিভাগে ৫ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৯৪ জন। অধস্তন আদালতে বিচারক সংখ্যা ২ হাজার ১৪৯ জন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩১ হাজার ১২০টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৯ হাজার ২৯১টি, ফৌজদারি মামলা ১১ হাজার ৬১৯টি এবং অন্যান্য ২১০টি।
হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১টি, যার মধ্যে দেওয়ানি ৯৮ হাজার ৬১৯টি, ফৌজদারি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮১টি, রিট মামলা ১ লাখ ১৫ হাজার ২১২টি এবং অন্যান্য ২০ হাজার ৮৩৯টি।
অধস্তন আদালতে মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭টি এবং ফৌজদারি মামলা ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৫টি।
সংস্কার ও সুপারিশ: কতটা বাস্তবায়নযোগ্য?
২০২৩ সালের আগস্টে আইন কমিশন মামলাজট কমাতে পাঁচটি মূল কারণ চিহ্নিত করে:
১. পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা
২. বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া
৩. মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা
৪. জনবল সংকট
৫. দুর্বল অবকাঠামো
কমিশন চার বছরে অন্তত পাঁচ হাজার নতুন বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেছিল। ২০১২ সালেও একই ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিচারাধীন মামলার চাপে আদালত অচল হয়ে পড়ছে। সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন, বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিথ্যা মামলা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে দ্রুত পুরোনো মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য কোনো নতুন পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র শফিকুল ইসলাম জানান, “প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। এর আলোকে সরকার জুডিশিয়াল অ্যাপয়নমেন্ট কাউন্সিল গঠন করেছে, যা কার্যক্রম শুরু করেছে। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে মামলাজট কমবে।”
মামলাজট দেশের বিচারব্যবস্থার অন্যতম বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না, যা আইনের শাসনকে দুর্বল করছে। বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি, আইনের আধুনিকায়ন, মিথ্যা মামলার প্রবণতা রোধ এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি কার্যকর করা—এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এ সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব। এখন দেখার বিষয়, সরকার ও বিচার বিভাগ কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে।