বিশ্বের অর্থনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের এক সতর্কবার্তা এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে। সংস্থাটির সর্বশেষ ‘ফিসক্যাল মনিটর ২০২৪’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক সরকারি ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁতে যাচ্ছে। এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কভিড-১৯ পরবর্তী সময় থেকে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে সরকারি খরচের এই ঊর্ধ্বগতি ঋণকে ঠেলে দিচ্ছে নতুন উচ্চতায়।
প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ফিরছে না। রাজনৈতিক চাপে পড়া বেশিরভাগ সরকার কর ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারে উদ্যোগী না হওয়ায় ঋণ কমাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে, জ্বালানি খাতে সবুজায়ন, বৃদ্ধ জনসংখ্যা, নিরাপত্তা সংকট এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পের চাপও সরকারি ব্যয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে। ফলাফল—ঋণ বেড়েই চলেছে।
আইএমএফের হিসাব বলছে, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৯৩ শতাংশে পৌঁছাবে সরকারি ঋণ। আর ২০৩০ সালের মধ্যে তা শতভাগের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। মহামারী পরবর্তী সময়ের ঋণ বৃদ্ধি এরই মধ্যে ২০১৯ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি হয়েছে।
বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিতব্য আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক বৈঠকের আগে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক নীতিমালা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি ব্যয় ও ঋণ চাহিদা যে হারে বাড়ছে, তা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
আইএমএফ বলছে, রাজনৈতিক কারণে কর সংস্কারে পিছিয়ে থাকা এবং ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় বহু দেশ ঋণ জালে আটকে পড়ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২০২৪ সালে প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতি দেখা যাবে, যা দেশটির জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। এর অর্থ, দেশটির ঋণ আরও বাড়বে এবং ভবিষ্যতে তা আরও ব্যয়বহুল হতে পারে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতেও একই রকম পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
আইএমএফের ডেপুটি ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক এরা ডাবলা-নরিস বলেন, ‘সরকারগুলো যদি সময়মতো ঋণ কমাতে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। বাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকিতে পড়বে, যা ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক আঘাত সামলাতে অক্ষম হয়ে পড়বে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ঋণ কমানোই নয়, সামাজিক খাতে বিনিয়োগ এবং কর আদায় ব্যবস্থার উন্নতিও জরুরি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে এই ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন বাস্তবায়ন করতে হলে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইএমএফের মতে, সরকারগুলোর উচিত ব্যয় কমানোর পাশাপাশি কর ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়া। তবে এই প্রক্রিয়া সহজ হবে না, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে ঋণ ও জিডিপির অনুপাত দিন দিন বাড়ছে।