ডিজিটাল আদালত বলতে মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) ব্যবহার করে গড়ে তোলা আধুনিক আদালত ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়। আদালতে কাজের গতি এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ডিজিটাল আদালত সিস্টেমের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ফাইলিং, কেস ম্যানেজমেন্ট এবং শুনানি পরিষেবাগুলি সম্পূর্ণরূপে একত্রিত করা সম্ভব হয়। এতে পক্ষ, আইনজীবী এবং আদালত একে অপরের সঙ্গে স্বচ্ছ ও দক্ষভাবে, বাস্তব সময়ের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। ডিজিটাল আদালত পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে, বিচারিক কার্যক্রম আরও গতিশীল, স্বচ্ছ এবং নাগরিকদের জন্য সহজ হবে।
এটি ফৌজদারি আদালত ডিজিটাল করার পদ্ধতি-
ফৌজদারি আদালতকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলা ফাইলিং পরিণত করতে হলে, প্রতিটি সিআর মামলার ফাইলিংয়ের সময় এক কপি প্রিন্ট কপি এবং এক কপি স্ক্যান কপিসহ আদালতের অফিসিয়াল ইমেইলে জমা দেওয়া যেতে পারে। এতে করে কোন ডকুমেন্টস নষ্ট বা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না, কারণ নীল হাজিরার কাগজে প্রিন্ট করা আর্জি একসময় নষ্ট হয়ে যায় এবং লিখা উঠে যায়।
আমলি আদালতের ওয়ারেন্ট ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রেরণ: ওয়ারেন্টের স্মারকসহ থানায় অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে স্ক্যান কপি প্রেরণ করা যেতে পারে। এই ওয়ারেন্টের শুধু স্মারক নম্বার আদালতের ওয়েবসাইটে দেওয়া যেতে পারে, যাতে থানা কর্তৃপক্ষ যাচাই করতে পারে। এতে অপরাধী ধরা দ্রুত ও সহজ হবে এবং জালিয়াতির মাত্রা কমবে। একই সঙ্গে আসামীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা ছবির স্ক্যান কপি দেওয়া যেতে পারে।
আসামি গ্রেপ্তার ও তদন্তে ডিজিটাল পদ্ধতি: কোনো আসামি গ্রেপ্তার হলে বা রিমান্ড চাইলে, তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের সার্ভারে অনলাইনে আপলোড করলে, জিআর পুলিশ সেকশন (জিআরও) আগেই বুঝতে পারবে যে, আজ কোন কোন নথি বের করতে হবে এবং কতজন আসামির প্রোডাকশন রয়েছে।
জামিন এবং রি-কল: কোনো আসামির জামিনের পর বেল বন্ড দাখিলের সময় ‘পরোয়ানা ফেরত’ বা রি-কল অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে আদালত থেকে সরাসরি থানায় পাঠানো যেতে পারে। এই রি-কলের শুধু স্মারক নাম্বার আদালতের ওয়েবসাইটে দেওয়া যেতে পারে, যাতে থানা কর্তৃপক্ষ যা অনলাইনে যাচাই করতে পারে এতে করে ভুয়া/জাল পরোয়ানা ফেরত বা রি-কল কেউ দাখিল করার সুযোগ পাবে না।
কারাগার থেকে আসামি মুক্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল ভার্সন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা-
আসামি মুক্তির প্রক্রিয়া আরো সহজ ও দ্রুত করার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার সময়ের দাবি। আসামির পরিবারের জন্য এই প্রক্রিয়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক, তা শুধু তারা জানে। বর্তমান পদ্ধতিতে, অনেক সময় আইনজীবীরা বেল বন্ড লিখতে গিয়ে ভুল বা এূটিপূর্ণ তথ্য দেন, যার ফলে এুটিপূর্ণ বেল বন্ডের জন্য আসামি মুক্তি পেতে দেরি হয়। এই সমস্যাগুলি সমাধান করতে, আইনজীবীদের ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে বেল বন্ড সরাসরি আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো যেতে পারে। আদালতের ওয়েবসাইটে বেল বন্ড স্বারক নম্বরসহ আপলোড করা যাবে এবং কারাগারের কর্তৃপক্ষ এটি যাচাই করতে পারবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে সময় বাঁচবে এবং প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হবে। (এই সেবা থেকে আসামীদের একটি নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ নেওয়া যেতে পারে।)
আত্মসমর্পণের আসামির প্রেরণ ও জানানো: আত্মসমর্পণকারী আসামীকে জেল হাজতে পাঠানো হলে, সেটি সঙ্গে সঙ্গেই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানানো প্রয়োজন।
জিআর মামলা হাজিরা পদ্ধতি: জিআর মামলায় পুলিশ রিপোর্ট (চার্জশীট/ফাইনাল রিপোর্ট) আসার আগ পর্যন্ত আসামিদের হাজিরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নেওয়া যেতে পারে। আসামির হাজিরার দিন ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ডিজিটাল টিপ সই দিয়ে হাজিরা দিবে এবং যদি কোনো আসামির শুনানি বা আদালতে উপস্থিতি প্রয়োজন হয়, তাহলে সিস্টেম থেকে লাল বাতি উঠবে এবং আসামি নির্ধারিত আদালতে হাজির হবে। ডিজিটাল ফিঙ্গার প্রিন্ট এর মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তি ৫ সেকেন্ডে হাজিরা দিতে পারবে এবং আদালতপাড়ার ভিড় কমবে।
জামিনের দরখাস্তের পুটাপ ইমেইলের মাধ্যমে জমা: আইনজীবীরা আসামির জামিনের দরখাস্তের পুটাপ স্ক্যান করে ইমেইলের মাধ্যমে আদালতে জমা দিতে পারবেন। পুটাপ অনুমোদন হলে, পরবর্তী সময়ে শুনানির সময় প্রিন্ট কপি সরবরাহ করা যাবে।
খণ্ড নথির আদান-প্রদান ডিজিটাল পদ্ধতিতে: কোন এক জেলার মামলায় আসামী অন্য জেলায় গ্রেফতার হলে অসহনীয় হয়রানি হতে হয়। অন্য জেলের মামলার খণ্ড নথি আদালতের অফিসিয়াল ই-মেইলে পাঠানো যেতে পারে, যা ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানোর চেয়ে অনেক দ্রুত হবে।
মামলার সাক্ষীদের সমন পদ্ধতি ডিজিটালাইজেশন: মামলার স্বাক্ষীদের সমন মেসেজ, কল বা ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে এতে সময় ও খরচ বাঁচবে।
জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রদান: বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট যাচাই করার ক্ষমতা দেওয়া উচিত, যাতে আসামি/বাদীর সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া, আসামির অতীত মামলার রেকর্ডও কম্পিউটার সিস্টেমে যাচাই করা যেতে পারে। এর ফলে, একটি জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অন্য কেউ জামিনের জন্য দাঁড়াতে পারবেন না এবং আসামির নামে কয়টা মামলা আছে তা ম্যাজিস্ট্রেট যাচাই করতে পারবে।
মামলায় জব্দ করা আলামতের উপস্থাপন: সাক্ষ্য-প্রদান শেষে, মামলায় জব্দ করা আলামত পাওয়ার পয়েন্টে ভিডিও ও অডিও রেকর্ড প্রোজেক্টরের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
ডাক্তারের সাক্ষী ভার্চুয়ালি নেওয়া: মেডিকেল রিপোর্টের ক্ষেত্রে, ডাক্তারের সাক্ষী ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে নেওয়া যেতে পারে, যা সময় ও খরচ কমাবে।
দেওয়ানী এখতিয়ার আদালতের বিচার কার্য: বর্তমানে দেওয়ানী আদালতের বিচার কার্য বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এই প্রক্রিয়াকে আরো দ্রুত, সুষ্ঠু এবং সহজ করতে পারে। ডিজিটাল পদ্ধতি, অনলাইন সিস্টেম এবং সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেওয়ানী আদালতের কার্যক্রম আরো কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব, যা সময় ও সম্পদের সাশ্রয় করবে এবং বিচার প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করবে।
ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে দেওয়ানী আদালত পরিচালনা-
মামলা ফাইলিং ও ডকুমেন্টস জমা দেওয়া: প্রতিটি দেওয়ানী মামলা ফাইলিংয়ের সময় এক কপি প্রিন্ট কপি ও এক কপি স্ক্যান কপি আদালতের অফিসিয়াল ইমেইলের মাধ্যমে জমা দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে, কোনও ডকুমেন্ট হারানো বা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। কারণ নীল হাজিরার কাগজের মতো প্রিন্ট করা আর্জি একসময় নষ্ট হয়ে যায়। ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে এসব সমস্যা প্রতিরোধ করা যাবে।
কোর্ট ফি গেটওয়ে সার্ভিসের মাধ্যমে পেমেন্ট: দেওয়ানী মামলায় কোর্ট ফি গেটওয়ে সার্ভিসের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যেতে পারে। এতে করে পেমেন্টের প্রক্রিয়া দ্রুত এবং সহজ হবে এবং কেউ ফি পরিশোধে সমস্যায় পড়বে না।
সহকারী জজদের অনলাইন পর্চা বা দলিল যাচাইয়ের ক্ষমতা: দেওয়ানী আদালত পরিচালনার সময় সহকারী জজদের অনলাইনে পর্চা বা দলিল যাচাই করার ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে বাদী বা বিবাদী জাল বা বানানো কাগজ উপস্থাপন করতে পারবে না এবং আদালত দ্রুত সঠিক দলিল যাচাই করতে পারবে।
জমি দখল নিয়ে মোকদ্দমায় ভিডিও প্রমাণ: জমি দখল নিয়ে মামলায় বাদীকে জমির বর্তমান অবস্থা দেখানোর জন্য ভিডিও রেকর্ড করে আদালতে জমা দিতে বলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আদালত সহজে জমির বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই করতে পারবে।
সাকসেশন মামলার ক্ষেত্রে সত্যতা যাচাই: সাকসেশন মামলায় সত্যতা যাচাইয়ের জন্য, জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু সনদ এবং ওয়ারিশসনদ অনলাইনে যাচাই করার ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কেউ মিথ্যা ডকুমেন্ট উপস্থাপন করতে পারবে না এবং মামলার প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।
পারিবারিক আদালত ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলা পরিচালনা পদ্ধতি-
পারিবারিক আদালতে অনেক নারী বা চাকরিজীবী মা, যাদের ছুটি নেই বা সন্তানদের দেখাশোনার কারণে আদালতে এসে মামলা পরিচালনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন, তাদের জন্য ডিজিটাল/ভার্চুয়াল আদালত একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। এটি আদালত কার্যক্রমকে আরও সহজ, দ্রুত এবং সুবিধাজনক করবে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে পারিবারিক আদালত পরিচালনার পদ্ধতি:
১. মোকদ্দমা ফাইলিং: প্রতিটি মামলার ফাইলিংয়ের সময় এক কপি প্রিন্ট ও এক কপি স্ক্যান কপিসহ আদালতের অফিসিয়াল ইমেইলে জমা দেওয়া যেতে পারে। এতে ডকুমেন্ট হারানোর সম্ভাবনা কমে যাবে এবং প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে।
২. বাদী ও স্বাক্ষীর হাজিরা: ফাইলিংয়ের সময় বাদীকে জানাতে হবে তিনি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হাজিরা দেবেন নাকি স্বশরীরে হাজির হবেন। একইভাবে, স্বাক্ষী যখন উপস্থিত হবে, তখন তাকে স্বশরীরে হাজির হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করতে হবে।
৩. দেনমোহর ও ভরণপোষণ মামলায় অটোমেটিক পেমেন্ট: দেনমোহর এবং ভরণপোষণ মামলায় যেহেতু টাকা সংক্রান্ত ডিক্রি দেওয়া হয়, তাই বিবাদীর ব্যাংক একাউন্ট অথবা বেতন থেকে প্রতিমাসে অটোমেটিক পেমেন্ট কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে দ্রুত এবং সহজভাবে ভরণপোষণ বা দেনমোহর পরিশোধ করা হবে।
৪. ভার্চুয়াল ট্র্যাফিক আদালত: ভার্চুয়াল ট্র্যাফিক আদালত একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হতে পারে, যেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মতো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। এর মাধ্যমে আইন অমান্যকারী পথচারী এবং ড্রাইভারদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে।
৫. আদালতের আদেশ ও তথ্য সংরক্ষণ: প্রতিটি আদালতের আদেশ ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। যেমন, “ডেমরা থানার মামলা নং ২(৩)২২, ধারা, জামিনের দরখাস্ত- আদেশ না মঞ্জুর, পরবর্তী তারিখ- ৭/১২/২২”। সকল তথ্য ক্লাউডে সংরক্ষণ করলে ডাটা হারানোর সম্ভাবনা থাকবে না এবং সহজে অ্যাক্সেস করা যাবে।
৬. বিশেষ মোবাইল নম্বর: প্রতিটি আদালতের জন্য একটি সরকারি মোবাইল নম্বর থাকা উচিত। যাতে আইনজীবীরা যোগাযোগ করে যেকোনো বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন।
৭. নির্বাচিত সময়ের মধ্যে ভার্চুয়াল কোর্ট: দেশের নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত, রাতে ভার্চুয়াল কোর্ট অথবা স্বশরীর আদালত পরিচালনা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমের গতি বাড়ানো সম্ভব হবে এবং মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত হবে।
- লেখক- মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান, এ্যাডভোকেট; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।