বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি মামলায় নতুন মোড় এসেছে। দীর্ঘ তদন্তের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রমাণ পায় যে, বাংলাদেশ ছাড়াও কমপক্ষে চার দেশের নাগরিক এই ঘটনায় জড়িত। চার্জশিট প্রস্তুত প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই এটি আদালতে দাখিল হবে।
তদন্ত সূত্র ইউএনবিকে জানায়, অভিযুক্তদের মধ্যে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রয়েছেন। ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়াও শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার গুরুতর গাফিলতি লক্ষ্য করা গেছে। তাদের কারো কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
সিআইডির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্র অত্যাধুনিক ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে চুরি সংঘটিত করে। ব্যাংকের আইটি বিভাগ সচেতনভাবেই ম্যালওয়্যারযুক্ত ফাইল খোলার মাধ্যমে এই সুযোগ দেয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার অবৈধভাবে স্থানান্তরিত হয়।
তিনি আরো জানান, চার্জশিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) বিস্তারিত প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এতে বিদেশি নাগরিকদের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকবে। এফবিআইকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে চার্জশিট দাখিল সম্পন্ন হবে।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে এই চুরি সংঘটিত হয়। সে সময় বাংলাদেশে ব্যাংক কার্যক্রম বন্ধ ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রেও সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়েছিল। হ্যাকাররা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার স্থানান্তরের চেষ্টা করে। তবে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারই সরাতে সক্ষম হয়।
চুরি হওয়া অর্থের বড় অংশ ফিলিপাইনের ক্যাসিনো শিল্পের গোপনীয়তা আইনের ফাঁক ব্যবহার করে পাচার হয়। এর মধ্যে আট কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে এবং প্রায় দুই কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয়। শ্রীলঙ্কা থেকে অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হলেও ফিলিপাইন থেকে উদ্ধার জটিল হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ ডলার সরকার উদ্ধার করতে পেরেছে।
তদন্তে সিআইডির পাশাপাশি এফবিআই, ফিলিপাইনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এনবিআই) ও শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক অংশ নেয়। পরে জাতিসংঘকেও লেনদেনের কৌশল ও ব্যবহৃত প্রযুক্তি জানানো হয়। ঘটনার ৩৯ দিন পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের তৎকালীন উপপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও তথ্য প্রযুক্তি আইনে অভিযোগ দাখিল করেন। পরে মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রায় নয় বছরের তদন্তে দেশী-বিদেশী শতাধিক সাক্ষীর জবানবন্দি, আইপি ঠিকানা, নেটওয়ার্ক লগ, ব্যাংক লেনদেনের তথ্য এবং ম্যালওয়্যার কোডসহ বিস্তৃত প্রযুক্তিগত প্রমাণ খতিয়ে দেখা হয়েছে। ফলে হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
সিআইডির আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে আন্তর্জাতিক আর্থিক অপরাধ চক্রের কৌশল, দেশীয় সহযোগীদের ভূমিকা ও সাইবার নিরাপত্তার দুর্বলতা স্পষ্ট হয়েছে। তিনি যোগ করেন, “আমরা চাই চার্জশিট এমনভাবে তৈরি হোক যাতে অপরাধীরা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আইনের মুখোমুখি হয়।”
চার্জশিট দাখিলের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত এই সাইবার ডাকাতির রহস্য উন্মোচিত হবে। এটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

