দুদকের বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি তদন্ত দেড় দশক পার হলেও আদালত তা ‘অসম্পূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে আদালত দুদককে আরও তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত ১২০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছেন কিন্তু এই সময়ের মধ্যে দুদক মাত্র ৩২টি মামলার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে। বাকিগুলো এখনও শুরু হয়নি। অদ্ভুত হলেও ব্যাংকের বোর্ড সভায় ঋণ অনুমোদন দেওয়ায় সবাইকে আসামি করা হয়নি। আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, ঋণ প্রস্তাবে সায় না দেওয়া কমিটিকে আসামি করতে এবং একই বিভাগের কাউকে আসামি, কাউকে সাক্ষী করতে হবে।
দুদক কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫৯ মামলার মধ্যে প্রায় ৫৪টির পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান ২০১০ সালে শুরু করে দুদক। তবে অনেক অভিযুক্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তদন্ত ধীরগতি দেখিয়েছে।
২০১৫ সালে প্রথম মামলা দায়ের করে দুদক। এরপর একে একে ৫৯টি মামলা করা হয় কিন্তু এসব মামলায় পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে অনেক ফাঁকফোকর ছিল। দীর্ঘদিন তদন্ত থমকে থাকার পর সমালোচনার মুখে ২০২৩ সালে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করে ৫৮টি মামলার চার্জশিট জমা দেয় দুদক। তবে চার্জশিটেও অন্যান্য পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের নাম যুক্ত হয়নি।
আওয়ামী লীগের পতনের পরও বাচ্চু ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত সেপ্টেম্বরে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও দুদক কর্মকর্তারা জানেন না তিনি কোথায় রয়েছেন। আদালত এখন এই মামলার পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। চার্জশিট ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে আদালত প্রথমবারের মতো অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। নতুন তদন্তে আশা করা হচ্ছে, পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্যরাও অভিযুক্ত হবেন। তবে অনুসন্ধান, তদন্ত ও অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে অসামঞ্জস্য থাকলে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম বলেন, “দুদক যেভাবে অনুসন্ধান করে, তা তদন্তের মতো। মামলায় পরিচালনা পর্ষদসহ সংশ্লিষ্ট সবার নাম আসা উচিত। এটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তার ভুল এবং কমিশনের ব্যর্থতা। দুদকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং করার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি।”
ব্যাংকের বোর্ড সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ঋণ অনুমোদন হলেও প্রথমে পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। পরে চার্জশিটে শুধু সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুকে আসামি করা হয়। ক্রেডিট কমিটিতে ঋণ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা কর্মকর্তারাও আসামি হয়েছেন। একই অভিযোগে কখনও কাউকে আসামি, কাউকে সাক্ষী করা হয়েছে। চার্জশিট পর্যালোচনার পর ৫৪টি মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত ১২০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলেছেন।
২০০৯ সালে জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য বাচ্চুকে চেয়ারম্যান করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। ব্যাংকটির পরিচালক হন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই মহাপরিচালক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বিসিক চেয়ারম্যান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। বেসরকারি খাত থেকেও প্রতিনিধি ছিলেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন বাচ্চু। এই সময়ে দিলকুশা, গুলশান ও শান্তিনগর শাখা থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া জাল দলিলে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
দুদকের কর্মকর্তা বলেন, “রাষ্ট্র ও দুদকের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপের কারণে হয়তো ব্যাংকের পরিচালকদের আসামি করা যায়নি। অধিকতর তদন্তে তাদেরকেও আসামির তালিকায় যুক্ত করা হবে।”
দুদকের একজন পরিচালক জানান, “এ পর্যন্ত ৩২টি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্তে পরিচালনা পর্ষদ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তার অপরাধ পাওয়া গেলে তাদের আসামি করা হবে। তদন্ত শুরুর তারিখ থেকে পরবর্তী ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে সব সম্পন্ন করার আশা করছি।”

