বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আজ এমন এক সংকটময় অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেখানে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধান কারণ ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বৃদ্ধি, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪.২০ লাখ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪.১৩%। অর্থাৎ প্রতি চার টাকার মধ্যে এক টাকার আদায় অনিশ্চিত। শুধু এটুকুই নয়, খেলাপি ঋণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাত্র ১১ থেকে ১২টি ব্যাংকে এই খেলাপি ঋণের ৭১%, যা ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে।
২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে একক ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭৪,৫৭০ কোটি টাকা, যা রেকর্ড ধাপে পৌঁছেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা সব চেয়ে নাজুক; তাদের Non-Performing Loan (NPL) রেশিও প্রায় ৪৫.৭৯%। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অবস্থার কোনটা আশ্বাসদায়ক নয়। ২০টি Non-Bank Financial Institution (NBFI)-এর মোট ঋণের ৮৩.১৬% এখন খেলাপি। দেশের ১১ হাজারেরও বেশি ব্যাংক শাখার মধ্যে প্রায় ১,৬৮০টি শাখা লোকসানে রয়েছে, যা ব্যাংকিং পরিষেবায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
ঋণখেলাপিরা সাধারণত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তারা সময়মত ফেরত দেয় না, অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান। পূর্বের সরকার আমলে এমন ঘটনার নজির বেশি। আইনগত প্রতিরোধ তখন সীমিত ও অস্পষ্ট ছিল। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় এই পরিস্থিতিতে নতুন মোড় এনেছে। রায়ের মাধ্যমে এখন প্রাক-ডিক্রি পর্যায়েও, অর্থাৎ মূল মামলার রায়ের আগে, জনস্বার্থে প্রয়োজন হলে আদালত ঋণখেলাপির বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করতে পারবে।
প্রেক্ষাপট তৈরি হয় চট্টগ্রামের দুই প্রভাবশালী ঋণ খেলাপির ঘটনার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে তারা ব্যাংক থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, কিন্তু জামানত ছিল না। ঋণ খেলাপি হওয়ায় ব্যাংক চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমানের কাছে তাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আবেদন করেন। বিচারক বিষয়টি বিবেচনা করে তাদের বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করেন এবং পাসপোর্ট জব্দ করেন।
ঋণগ্রহীতারা হাইকোর্টে রিট করেন (Writ Petition No. 6083 of 2024 & 6234 of 2024-Mujibur Rahman & Others; Jewel Khan & Others vs Judge, Artha Rin Adalat, Chattogram & Others) তারা দাবি করেন, বিচারিক আদালতের এই আদেশ সংবিধান লঙ্ঘন এবং প্রাক-ডিক্রি পর্যায়ে ক্ষমতা নেই। তাদের মতে, এই ক্ষমতা কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা উচিত। ব্যাংকের যুক্তি ছিল স্পষ্ট — ঋণ খেলাপিরা যদি বিদেশে চলে যায়, জনগণের সঞ্চয় ফেরত পাওয়া কঠিন হবে। পূর্বে এমন বহু নজীর রয়েছে।
হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ (মাহমুদুল হক, মো. আশরাফুল কামাল, মো. জাকির হোসেন) রায়ে বলেন, সংবিধানে চলাফেরার স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। জনস্বার্থে আইন দ্বারা এটি সীমিত করা যেতে পারে। সংবিধানের আর্টিকেল ৩৬-এর ভাষ্য অনুযায়ী, “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে” দেশের নাগরিকদের চলাফেরা, বসবাস ও পুনঃপ্রবেশের অধিকার রয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়, “অর্থ ঋণ আদালত আইন” এর ৫৭ ধারা আদালতকে খেলাপি ঋণ আদায়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষমতা দেয়, যা প্রয়োজনে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, মূল মামলার রায়ের আগে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় ১২টি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। যেমন, ঋণ অনিরাপদ হলে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কম, ঋণগ্রহীতা পালানোর ঝুঁকি রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের “ইচ্ছাকৃত খেলাপি” তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, ঋণ ব্যবসায় না ব্যবহার করা, সম্পত্তি গোপন বা বিদেশে স্থানান্তর চেষ্টা ইত্যাদি। রায়ে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা অস্থায়ী ও অনুপাতিক হবে। উল্লেখযোগ্য অর্থ পরিশোধ বা যথাযথ জামানত দিলে তা প্রত্যাহার করা যাবে।
এই রায় বাংলাদেশের ঋণ পুনরুদ্ধার আইনে যুগান্তকারী। অর্থ ঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান অরক্ষিত খেলাপি ঋণ ও পলায়নের ঝুঁকি দেখে জনগণের আমানত সুরক্ষায় তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। সংবিধানিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তার পদক্ষেপ হাইকোর্টের পূর্ণ বেঞ্চ দ্বারা বহাল থাকে।
রায় স্পষ্ট করে, ঋণখেলাপি শুধু ব্যক্তিগত চুক্তি ভঙ্গ নয়, এটি জনস্বার্থবিরোধী আর্থিক অপরাধ। ব্যক্তিস্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। যারা ভাবেন কোটি কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালাবেন, তাদের জন্য এই রায় কড়া সতর্কবার্তা। রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামো এখন সব পদক্ষেপ নজরে রাখবে। বিচারক মুজাহিদুর রহমানের হস্তক্ষেপ প্রথমে বিতর্কিত হলেও পরে প্রমাণিত হয়েছে, এটি ন্যায়বিচার ও আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষায় একটি অনিবার্য পদক্ষেপ।