সরকার প্রথমবারের মতো পৃথক দায়রা (ফৌজদারি) এবং পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের জন্য সাত শতাধিক নতুন বিচারকের পদ সৃজন করা হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত দায়রা আদালতের জন্য ২০৩টি, যুগ্ম দায়রা আদালতের জন্য ৩৬৭টি এবং পারিবারিক আদালতের জন্য ১৬৩টি পদ তৈরি করা হয়েছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ বিচার কাজে গতি আনবে, মামলার জট কমাবে এবং বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি হ্রাস করবে। দেশে বর্তমানে ৪৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। অথচ বিচারকের সংখ্যা মাত্র দুই হাজারের মতো। জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে এ সংখ্যা অত্যন্ত কম। ফলে আদালতে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকা বিচারকরা অতিরিক্ত চাপের মধ্যে কাজ করছেন। একজন বিচারককে এক সঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা বিচার করতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল ও অন্যান্য আদালতের দায়িত্বও পালন করতে হয়। এতে বিচারকাজের গতি কমে যায় এবং মামলার জট বাড়ে।
‘দ্যা সিভিল কোর্টস অ্যাক্ট-১৮৮৭’-এর ৩ ধারায় দেওয়ানি মামলা জন্য জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ আদালত স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ‘দ্যা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮’-এর ৯ ধারায় ফৌজদারি মামলা জন্য দায়রা আদালত, অতিরিক্ত দায়রা আদালত ও যুগ্ম দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পারিবারিক আদালত আইনেও পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপনের কথা বলা রয়েছে। তবুও যুগের পর যুগ বিচারকরা এক সঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা বিচার করছেন। পারিবারিক আদালতের দায়িত্বও সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালত পালন করে আসছে।
গত মে পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৩৪,৩৪২টি দেওয়ানি এবং ১,৭৫,৮৭২টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন ছিল। যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১,৮২,৮৩২টি দেওয়ানি ও ৩,৫৫৭টি ফৌজদারি মামলা চলমান ছিল। বর্তমানে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মোট ৭ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন।
এছাড়া সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ৯,১৩,৪৪৯টি দেওয়ানি ও ১,১৯,৮৩০টি পারিবারিক মামলা বিচারাধীন। পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ৪ ধারায় প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক স্বতন্ত্র পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ আদালতগুলো বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের হেফাজত, ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব সম্পর্কিত বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তি করে। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো পারিবারিক আদালত স্থাপন হয়নি।
দেওয়ানি আদালতের বিপুল মামলার চাপ ও সহকারী জজদের অতিরিক্ত দায়িত্বের কারণে বিচার বিলম্ব হচ্ছে। ২১ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়ে পৃথক আদালত স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিচারকের অতিরিক্ত দায়িত্বের কারণে প্রত্যাশিত সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রধান বিচারপতি পৃথক আদালত স্থাপন ও পদসৃজনের নির্দেশনা দেন। বর্তমান আইন উপদেষ্টা ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কমিশন প্রতি ৮০০ মামলার বিপরীতে একজন বিচারক প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেছে।
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘পৃথক ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত এবং পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপন আইনি বাধ্যবাধকতা। এ পদক্ষেপ বিচারকাজে গতি আনবে। এটি বিচার বিভাগ সংস্কারের বড় মাইলফলক।’ সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ মোয়াজ্জাম হোসাইন বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় পদসৃজন ও আদালত পৃথককরণের কাজ শুরু হয়েছে। এতে বিচারিক কাজে গতি আসবে।’