বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ১১ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষতার উদ্যোগ নেন।
এর ধারাবাহিকতায় ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণ প্রদান করেন তিনি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সম্পাদকসহ সারা দেশের জেলা আদালতের বিচারকরা।
প্রধান বিচারপতি তাঁর অভিভাষণে বিচার বিভাগ সংস্কারের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। সেখানে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণ নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। পাশাপাশি, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নের রূপরেখা তুলে ধরেন। আজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫। এই দিনে পূর্ণ হবে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছর। গত এক বছরে ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে।
২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি অভিভাষণে দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পালনের প্রতিশ্রুতি দেন। পাশাপাশি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দ, বদলি–পদায়নে স্বচ্ছ নীতিমালা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন, দুর্নীতি বিলোপ এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিচারসেবা নিশ্চিত করার রূপরেখা তুলে ধরেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিগত এক বছরে বিচার বিভাগে গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। এসব পরিবর্তন কেবল কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের কার্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গত এক বছরে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক জনবান্ধব বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নেয়া উদ্যোগগুলোর বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো।
উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নতুন অধ্যাদেশ:
২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশ ও উন্নত বিশ্বের নিয়োগ প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের মতামত নিয়ে খসড়াটি ২৮ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার পর খসড়াটি নীতিগত অনুমোদন পায়। পরবর্তীতে ২১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ পাস হয়। ওই অধ্যাদেশের আওতায় প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মেধা, দক্ষতা ও সততার ভিত্তিতে এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।
বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনে অগ্রগতি:
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে ২৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের কার্যকর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এজন্য একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং Rules of Business ও Allocation of Business-এ সম্ভাব্য সংস্কার প্রস্তাব করা হয়।
সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি, সংবিধানের ৪র্থ তফসিলের দফা ৬(৬) অনুযায়ী অধস্তন আদালত সম্পর্কিত বিধান দ্রুত বাস্তবায়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। সুপ্রীম কোর্ট প্রস্তাবিত সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা ও ছুটি সংক্রান্ত দ্বৈত শাসন শেষ হবে। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগ এক রিট মামলায় সরকারকে আগামী তিন মাসের মধ্যে পৃথক সচিবালয় স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
বিচার সেবায় স্বচ্ছতা আনতে প্রধান বিচারপতির ১২ দফা:
বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক করার লক্ষ্য নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা উদ্যোগ নেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এর অংশ হিসেবে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে তিনি ১২ দফা নির্দেশনা ঘোষণা করেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় প্রতি মাসে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে মনিটরিং সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সভায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেবা সহজীকরণে গৃহীত পদক্ষেপের রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, জেলা আদালতগুলোতেও একই ধরনের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এর ফলে বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিচারপ্রার্থীরা উন্নত সেবা পাচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্টে পেপার ফ্রি বেঞ্চ চালু:
বিচারসেবাকে জনবান্ধব করতে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখ থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কোম্পানি সংক্রান্ত একটি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজমুক্ত (পেপার ফ্রি) বিচার কার্যক্রম চালু হয়। এই কার্যক্রমের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে, যেখানে সব নথি অনলাইনে জমা দেয়া যায়। পরে ২০ জুলাই ২০২৫ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগের আরেকটি কোম্পানি বেঞ্চেও পেপার ফ্রি কার্যক্রম চালু হয়। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বেঞ্চেও এ কার্যক্রম বিস্তারের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের জন্য সেবা আরও সহজ ও আধুনিক হবে।
আসামিদের জন্য লিগ্যাল এইড নিশ্চিতকরণে নতুন ব্যবস্থা:
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে ২৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এতে বলা হয়, আদালতে উপস্থিত কোনো আসামির পক্ষে যদি আইনজীবী না থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে জাতীয় লিগ্যাল এইড প্যানেল থেকে একজন আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আসামির পক্ষে যদি কোনো আইনজীবী নিযুক্ত থাকেন, তবে তিনি যেন নির্বিঘ্নে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা নির্দেশনা দেয় যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে আসামি নিজে আইনজীবী নিয়োগে অক্ষম হলে তাকে অসমর্থ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে।
প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা সারা দেশের লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে আদালতে কোনো আসামি আইনগত সহায়তা থেকে বঞ্চিত থাকছেন না।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নতুন অগ্রগতি:
বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতি বিশেষ গুরুত্ব দেন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা প্রণয়নে। তাঁর উদ্যোগে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পূর্ববর্তী বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭ রহিত করে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করে। ফলে ২৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণীত হয়। এই বিধিমালা বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
মামলা জট নিরসনে পৃথক দেওয়ানি ও ফৌজদারী আদালত চালু:
মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে দেওয়ানি ও ফৌজদারী এখতিয়ার অনুযায়ী পৃথক আদালত চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ২১ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত একটি পত্র আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। বর্তমানে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ একইসাথে দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারী আপিল, ফৌজদারী রিভিশনসহ বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের মামলা পরিচালনা করছেন। ফলে বিচারকের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষত দেওয়ানি মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে।
এই সমস্যার সমাধানে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে পৃথক এখতিয়ার অনুযায়ী আদালত স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃজনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৪ থেকে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক দায়রা বিভাগ পুনর্গঠনের সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
বিচার বিভাগে দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ চালু:
বিচার বিভাগে মেধার বিকাশ ও কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি তাঁর রোডম্যাপ ঘোষণায় প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ চালুর উদ্যোগ নেন। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট একটি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করে। খসড়াটি ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। বর্তমানে এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই ফেলোশিপ চালু হলে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি:
দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি ও বিচারপ্রার্থী জনগণের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। প্রধান বিচারপতির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা ২০২৫ এর আওতায় গঠিত সার্ভিসের বিচারিক পদ সৃজন কমিটি ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। কমিটির ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ১৯১টি পদসহ মোট ২৩২টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ আদালত এবং সিটি কর্পোরেশনের বিচারিক পদে নিয়োগ নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি, ২৭ ফেব্রুয়ারি ও ১৩ মার্চ ২০২৫ তারিখে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৃথক পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত:
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। তবে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ পরবর্তীতে সংশোধনীটি অবৈধ ঘোষণা করে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হলে ২০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরায় কার্যকর হয়।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট এই কাউন্সিল ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতির পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেন। এর আগে ১৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ প্রদান থেকে বিরত রাখা হয়। তাঁদের মধ্যে বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে পদত্যাগ করেন। একই তারিখে বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম এবং এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের অতিরিক্ত বিচারপতির মেয়াদ শেষ হয়। এছাড়া বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে এবং বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে অবসরে যান।
কাউন্সিলের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি খিজির হায়াতকে ১৮ মার্চ ২০২৫ তারিখে এবং বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে ২১ মে ২০২৫ তারিখে অপসারণ করেন। সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে বিচারপতি আখতারুজ্জামানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে আরও চার বিচারপতির বিষয়ে কাউন্সিলের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বিচারকদের বদলি ও পদায়নে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ:
প্রধান বিচারপতির ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নে বৈষম্য দূর করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট একটি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করেছে। খসড়াটি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। নীতিমালা কার্যকর হলে বদলি ও পদায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিচারপ্রার্থীদের সহায়তায় সুপ্রিম কোর্ট হেল্প লাইন চালু:
বিচারপ্রার্থীদের সেবা সহজ করতে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্টে হেল্প লাইন চালু করা হয়। সেবাগ্রহীতারা রেজিস্ট্রির যেকোনো শাখায় সমস্যায় পড়লে এই নম্বরে কল করে সহায়তা নিতে পারেন। সহকারী রেজিস্ট্রার পদমর্যাদার একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হেল্প লাইন পরিচালনা করেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করেন।
সেবাটি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় হেল্প লাইন চালু করা হয়। সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতি রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হেল্প লাইন খোলা থাকে। পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও সেবা পাওয়া যায়। ৩১ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত হেল্প লাইনে সারা দেশ থেকে মোট ৩ হাজার ৭২টি কল এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৬৮টি কল ছিল আইনি পরামর্শের জন্য, আর ১ হাজার ১৫৭টি কল মামলার তথ্য জানার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।
সারাদেশের আদালতে হেল্প লাইন চালু:
বিচার সেবায় জনগণের অভিগম্যতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতি ১৪ মে ২০২৫ তারিখে দেশের সব আদালতে হেল্প লাইন চালুর ঘোষণা দেন। এর আগে ১৩ মে ২০২৫ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। এ উদ্যোগের ফলে দেশের ৬৪ জেলা ও ৮ মহানগর এলাকায় সুপ্রিম কোর্টের আদলে হেল্প লাইন চালু হয়। বিচারিক সেবা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা ও অনিয়ম দূর করাই এর মূল লক্ষ্য।
সার্কুলারে প্রতি জেলায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়। মনোনীত একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হেল্প লাইনের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কমিটি মাসিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জেলা ও দায়রা জজের মাধ্যমে প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। হেল্প লাইন চালুর অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট দেশের প্রতিটি জেলা জজশীপে জেলা ও দায়রা জজের কাছে একটি সীম কার্ডসহ মোবাইল ফোন সরবরাহ করেছে।
বিচার বিভাগে আস্থা ফেরাতে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম:
বিচার বিভাগ জনগণের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত—এই মূল দর্শন সামনে রেখে প্রধান বিচারপতি ২০২৫ সালে সারা দেশে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেন। জনগণের প্রত্যাশা কী এবং সেই প্রত্যাশা পূরণে বিচার বিভাগের করণীয় কী হতে পারে, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে বিভাগীয় শহরগুলোতে ইউএনডিপির সহায়তায় “Judicial Independence and Efficiency” শীর্ষক আঞ্চলিক কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। এতে বিচারক, আইনজীবী, উন্নয়ন সহযোগীসহ বিভিন্ন অংশীজন অংশ নেন। এসব কনফারেন্স প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নের বাস্তব রূপরেখা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
পরিবেশ বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার:
৩ মার্চ ২০২৫ তারিখে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে “Upholding Environmental Justice: The Role of Judges for a Sustainable Future” শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রাজিলের ন্যাশনাল হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি Mr. Justice Antonio Herman Benjamin। অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও রেজিস্ট্রির কর্মকর্তারা অংশ নেন।
জাতীয় সেমিনারে বিচার বিভাগের দক্ষতা নিয়ে আলোচনা:
২২ জুন ২০২৫ তারিখে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে “Judicial Independence and Efficiency in Bangladesh” শীর্ষক জাতীয় সেমিনার আয়োজন করা হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। সভাপতিত্ব করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং বার কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। অনুষ্ঠানে সুপ্রীম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, দেশের বিভিন্ন জেলার জেলা ও দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনজীবী ও আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশ নেন।
বিচারিক কূটনীতিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা:
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট, জিআইজেড, ইউনিসেফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সভা, সেমিনার ও প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এসব সংস্থা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, পোল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এতে তিনি বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। পাশাপাশি তুরস্ক, থাইল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল সফর করে সেসব দেশের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেছেন। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠকে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আধুনিকায়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রধান বিচারপতি সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। থাইল্যান্ডে “Achieving Just Societies: Inclusive Justice Pathways for People and Planet in Asia and the Pacific” সেমিনারে, দুবাইয়ে “World Governments Summit 2025” এ এবং আবুধাবির এনওয়াইইউ-তে “Climate Justice and the Constitution: Reflections from the Global South” লেকচারে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। এছাড়া জাতিসংঘ আয়োজিত UNDP Annual Rule of Law Conference-এও বক্তব্য রাখেন। এসব আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে প্রধান বিচারপতি বিচারিক কূটনীতি দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেছেন এবং বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠন:
বিচারকদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতি রোডম্যাপ ভাষণে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৬ আগস্ট ২০২৫ তারিখে আপিল বিভাগের বিচারপতি এস এম এমদাদুল হককে পে-কমিশনের সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। এছাড়া, ১৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখে সুপ্রীম কোর্ট থেকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়। এতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিদ্যমান পে-স্কেলে ৩০ শতাংশ বিচারিক ভাতা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়। বিষয়টি বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিচারকদের জন্য সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা চালু: সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতো বিচারকদের জন্যও সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ নেন প্রধান বিচারপতি। এ লক্ষ্যে ১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অনুকূলে সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
আদালত প্রাঙ্গণ ও বিচারকদের নিরাপত্তায় বিশেষ উদ্যোগ: সারা দেশের আদালত প্রাঙ্গণ এবং সেখানে কর্মরত বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এ লক্ষ্যে ২৮ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। পরে ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও আদালত ও বিচারকদের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য আলাদা নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কার উদ্বোধন: ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার সংস্কারকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষ উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় এই সংস্কার নতুন যুগের সূচনা করবে। তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন, ঐতিহাসিক ‘ঢাকা হাইকোর্ট’ বা ‘পুরাতন হাইকোর্ট ভবন’ হিসেবে পরিচিত এই স্থাপনাটি বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারের শাশ্বত নীতির অনুসরণে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
চৌকি আদালতে কম্পিউটার সরবরাহে আধুনিকায়নের উদ্যোগ: বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে দ্রুত বিচারসেবা পৌঁছে দিতে আধুনিকায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এর অংশ হিসেবে দেশের দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত চৌকি আদালতসমূহে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সুপ্রীম কোর্ট থেকে ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এই উদ্যোগের আলোকে ২ জুলাই ২০২৫ তারিখে দেশের ৪০টি চৌকি আদালতের এজলাস ও দপ্তরে ব্যবহারের জন্য মোট ৭১টি ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ২৩ জেলায় মোট ৪০টি চৌকি আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যক্রম চলছে। এসব আদালতে সিনিয়র সহকারী জজ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, যুগ্ম জেলা জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজরা দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন সরবরাহকৃত কম্পিউটারগুলো চৌকি আদালতের কার্যক্রমে গতি আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অধস্তন আদালতে ৪০০ কম্পিউটার ও ১২০ ল্যাপটপ সরবরাহ:
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ১১ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের আদালতসমূহের বিচার কার্যক্রমে গতি আনতে প্রযুক্তি সরবরাহে উদ্যোগ নেন। তাঁর নির্দেশনায় সুপ্রীম কোর্টের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত জেলা আদালতসমূহে মোট ৪০০টি ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া, একই সময়ে ১২০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে সুপ্রীম কোর্ট ল্যাপটপ কম্পিউটার দিয়েছে।
প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপের এক বছরে এসব উদ্যোগ বিচার বিভাগে শুধু প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার বাস্তবায়নেরও প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব হয়ে বিশ্বমানে পৌঁছাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

