বাংলাদেশে ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে দুইটি প্রবণতা মিডিয়া ট্রায়াল ও মব জাস্টিস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের আগে রায় দিয়ে দেওয়া কিংবা জনতার হাতে বিচার তুলে নেওয়া দুটিই আইনের শাসনের জন্য ভয়ংকর হুমকি।
মিডিয়া ট্রায়াল: মিডিয়া ট্রায়াল হলো, বিচার শেষ হওয়ার আগেই গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচার করা, যাতে আসামিকে “দোষী” বানানো হয়। এতে জনমত প্রভাবিত হয়, বিচারক চাপের মুখে পড়েন এবং আইনি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। আরো বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে বলা যায়, কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং আদালতে বিচারিক রায় ঘোষণার আগেই সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণ তার বিরুদ্ধে একধরনের রায় দিয়ে ফেলেন। জনসাধারণের দেওয়া সেই রায় ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধেও যেতে পারে, আবার পক্ষেও যেতে পারে। সোস্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত জনসাধারনের মতামত,তাদের লেখা বিভিন্ন স্ট্যাটাস এর মধ্যে পড়ে।
এই ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে অভিযুক্ত যে কেউ আদালতে বিচারের রায় ঘোষিত হবার আগেই জনতার আদালতে বহুভাবে এবং বিচিত্রভাবে রায়ের সম্মুখীন হন। এতে করে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে মর্যাদা ক্ষুন্ন হবার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মনে গভীর রেখাপাত করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনসাধারণের দেওয়া এই রায় নেতিবাচকই হয়ে থাকে। প্রকৃত ট্রায়ালের আগেই এই ধরনের ট্রায়াল নৈতিক বিচারে একদমই উচিত নয়। কারন আপনি কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আদালতে রায়ের আগে যে রায়টি দিবেন তা অন্যদেরকেও প্রভাবিত করতে পারে। এই জন্য বিচারাধীন কোন বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে। কোন সাবজুডিস বিষয়ে রায় প্রদানের মত মন্তব্য করা যায় না কিংবা কোন লেখাও দেওয়া যায় না । সেটি অনেকটাই আদালত অবমাননার সামিল। কারন, আদালত যে কাজটি করার কথা আপনি তা এক্তিয়ার বর্হিঃভূতভাবে নিজেই করে ফেলছেন।
কিছু আলোচিত উদাহরণ:
- ১৯৯০-এর দশকে কৃষক নেতা তাজুল ইসলাম হত্যা মামলায় প্রাথমিক প্রচারণা জনমতকে প্রভাবিত করে।
- ২০১২ সালে সাগর–রুনি হত্যা মামলায় তদন্ত চলার সময় নানা গুজব ছড়ানো হয়।
- ২০১৭ সালের তিস্তা সেতু ও রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলায় আসামিদের নাম–ছবি প্রকাশ করে দোষী আখ্যা দেওয়া হয়।
- ২০১৯ সালে প্রিয়া সাহার বিষয়ে “দেশদ্রোহী” প্রচারণা চালানো হয়, যদিও তখন মামলা হয়নি।
- ২০২১ সালে পরীমনির মাদক মামলায় আদালতের আগে সংবাদমাধ্যমে তাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
মিডিয়া ট্রায়ালে আসামির সামাজিক জীবন নষ্ট হয়, ন্যায়বিচারে বাধা সৃষ্টি হয়, আর বিচার ব্যবস্থার ওপর জনআস্থা কমে যায়। এ থেকে উত্তরণের জন্য গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে, সংবেদনশীল মামলায় ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ প্রচার করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তদন্তের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। সাংবাদিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ জরুরি।
মব জাস্টিস: মব জাস্টিস হলো যখন আইন ও বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একদল মানুষ একত্রিত হয়ে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মারধর, নির্যাতন বা হত্যা করে শাস্তি দেয়। এই ধরনের ঘটনাকে “উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার” বা “নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া” বলা হয়। এটি একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা, যা প্রায়শই গুজব এবং ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ঘটে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
মব জাস্টিস বৃদ্ধির প্রধান কারণসমূহ: মব জাস্টিস বা গণপিটুনির প্রবণতা বাড়ার পেছনে বেশ কিছু সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই কারণগুলোকে চিহ্নিত করেছেন,
- আইন প্রয়োগে দুর্বলতা: যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তখন সাধারণ মানুষ নিজের হাতে বিচার তুলে নিতে শুরু করে।
- বিচার বিভাগের দুর্বলতা: অপরাধীদের শাস্তি পেতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দিলে জনমনে অধৈর্যতা তৈরি হয়। এ হতাশাই অনেক সময় মব জাস্টিসের জন্ম দেয়।
- সামাজিক অসাম্য: নিম্নবর্গের মানুষ আইনের সহায়তা নিতে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। ন্যায়বিচার পেতে না পারায় তারা নিজেরাই বিচার করতে উদ্যত হয়।
- রাজনৈতিক উত্তেজনা: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংস পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমে ওঠে। এই উত্তেজনাই মব জাস্টিসের মতো ঘটনার জন্ম দেয়।
- সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: সমাজে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ কমে গেলে সহিংসতার প্রবণতা বাড়ে। এতে মানুষ আইন ও নিয়ম উপেক্ষা করে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চায়।
- মিথ্যা তথ্যের প্রসার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর ও গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এসব তথ্য উত্তেজনা ছড়ায় এবং জনতাকে উসকে দেয় মব জাস্টিসে অংশ নিতে।
ভয়াবহ পরিণতি: বাংলাদেশে মব জাস্টিস বা গণপিটুনির ঘটনা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু আইনের শাসনকে দুর্বল করছে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। মব জাস্টিস কার্যত আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে, যা সমাজে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, নিরপরাধ মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে। অনেক সময় গুজব বা ভুল তথ্যের কারণে নিরপরাধ মানুষও জনতার রোষানলে পড়েন। এতে অমূল্য প্রাণহানি ঘটে এবং ন্যায়বিচার পুরোপুরি ব্যাহত হয়। তৃতীয়ত, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মব জাস্টিসের ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয় এবং পর্যটন খাতও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা:
- ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
- একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদকে মারধর করা হয়, পরে তিনি মারা যান।
- ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মসজিদের মাইকে “ডাকাত” ঘোষণা দেওয়ার পর দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
- একই মাসে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে ডাকাত সন্দেহে ৫ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।
- নোয়াখালীর কবিরহাটে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে চোর ভেবে হত্যা করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব—এসব কারণেই মব জাস্টিস বাড়ছে। বিচার বিভাগের সংস্কার জরুরি। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে। জনসচেতনতা এবং নৈতিক শিক্ষা প্রসার জরুরি। গুজব ঠেকাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
মিডিয়া ট্রায়াল ও মব জাস্টিস ন্যায়বিচারকে দুর্বল করছে। একদিকে সংবাদমাধ্যম আদালতের আগে রায় দিচ্ছে, অন্যদিকে জনতা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে, বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্র, গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাজ না করলে এই প্রবণতা রোধ সম্ভব নয়।

