গত বছরের আগস্টে ব্যাংকে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে গেলে আমিনুল ইসলাম ভেবেছিলেন কেবল নিয়মিত কাগজপত্র জমা দিয়ে কাজ শেষ হবে কিন্তু তার বদলে তিনি বাড়ি ফিরলেন গভীর উদ্বেগে। জানানো হয়, তাঁর নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) ডাটাবেজে ঋণখেলাপিদের তালিকায় উঠেছে।
বড় ধাক্কা আসে পরে—আমিনুল জানতে পারেন, তাঁর বিরুদ্ধে এমন একটি অর্থঋণ মামলা হয়েছে যা তিনি কখনো নেননি। চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিকারক আমিনুল ব্যাংকিং খাতে নিখুঁত লেনদেনের রেকর্ড রাখতেন। তিনি জানেন গ্যারান্টর বা ঋণ জামিনদারের দায়িত্ব কত জটিল। শুধু তাঁর ক্ষেত্র নয়, বাংলাদেশে হাজারো মানুষ আবিষ্কার করছেন—বন্ধু বা আত্মীয়ের ঋণের গ্যারান্টর হয়ে নিজেরাও ব্ল্যাকলিস্টে পড়ছেন, সম্পদ হারানোর ঝুঁকিতে, এমনকি যে ঋণ তারা কখনো নেননি তার জন্যও অযাচিত মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। আইন অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে গ্যারান্টর স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়ী হন। সিআইবিতে তাদের নাম ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক আদালতের মাধ্যমে গ্যারান্টরের সম্পত্তি নিলামে তুলতে পারে অপরিশোধিত ঋণ আদায়ে।
ব্যাংকিং আইন বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমরান আহমেদ ভুঁইয়া বলেন, “ঋণখেলাপি হলে ঋণ আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতা ও গ্যারান্টর উভয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। ঋণগ্রহীতার বন্ধকী সম্পত্তি যথেষ্ট না হলে গ্যারান্টরের সম্পত্তিও নিলামে বিক্রি হতে পারে।” তবে গ্যারান্টর মূল ঋণগ্রহীতার সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করলে সেই অর্থ আদায়ের কোনও প্রক্রিয়া আইনতে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ব্যাংক সবকিছু আইন অনুযায়ী করে। আমরা কাউকে ঋণ নিতে প্রভাবিত করি না। তবে ঋণগ্রহীতা ক্লিন ইমেজের হলে আইন অনুযায়ী ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। এখন অনেক ক্ষেত্রে গ্যারান্টর নিয়োগ কমেছে।”
আমিনুল হাইকোর্টে রিট করে সাময়িকভাবে নাম খেলাপির তালিকা থেকে সরাতে সক্ষম হন। নাহলে পড়তে হতো চরম আর্থিক বিপর্যয়ে। ঝামেলায় জড়ান তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনিসুর রহমানের কারণে। ২০১৭ সালে টঙ্গীর গোল্ডেন ফ্যাশনের মালিক আনিসুর রহমান জনতা ব্যাংক থেকে কারখানা ও জমি বন্ধক রেখে ২১ কোটি টাকার ঋণ নেন। বন্ধুত্ব ও ব্যবসাসূত্রে দুই যুগের পরিচয়ের ভরসায় আমিনুল গ্যারান্টর হন।
তিনি বলেন, “বন্ধুর ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে আমার নাম খেলাপির তালিকায় উঠবে কল্পনাও করতে পারিনি। ব্যাংকের সাথে আমার সম্পর্ক দুই যুগের বেশি, কিন্তু কখনো খেলাপির তালিকায় নাম ওঠেনি।” আনিসুরের ব্যবসা ধসে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সুদে-আসলে ঋণ বেড়ে ৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। জনতা ব্যাংক আনিসুর ও আমিনুল —উভয়কেই খেলাপি ঘোষণা করে গাজীপুর অর্থঋণ আদালতে মামলা করে।
আমিনুল বলেন, “ব্যাংক চাইলে আমাকে খেলাপি না দেখাত। ওই ঋণের বিপরীতে যে সম্পত্তি রয়েছে, সেটি দিয়েই ব্যাংকের টাকা উঠানো সম্ভব ছিল কিন্তু আমাকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। পরে হাইকোর্টে রিট করে সিআইবি থেকে নাম স্থগিত করি। ব্যবসা পুনরায় চালু করি।” সবাই আমিনুলের মতো ভাগ্যবান হননি।
রফিক খান জামিনদার হয়ে ধসে পড়েন। তাঁর শ্যালক আতাউর রহমান ২০১১ সালে এবি ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকার ঋণ নেন। ঋণ খেলাপি হলে সুদে-আসলে তা ৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। নারায়ণগঞ্জের অর্থঋণ আদালত আতাউরের বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রির আদেশ দেয়। তবে বিক্রি থেকে পাওয়া যায় মাত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা। ব্যাংক জানতে পারে আতাউরের অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই। এরপর আদালত রফিক খানের সম্পত্তি জব্দের অনুমতি দেয়।
রফিক বলেন, “ফুয়েল স্টেশনসহ ১১ কাঠা জমি নিলামে গেছে। কোনো বিডার না আসায় ব্যাংক সম্পত্তি নিজের নামে নেয়। জীবন দুর্বসহ হয়ে পড়েছে।” এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এ. (রুমী) আলী বলেন, “গ্যারান্টর হওয়ার আগে সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঋণ খেলাপি হলে গ্যারান্টরও সমস্যায় পড়তে পারে।”
ঢাকার সাতটি অর্থ ঋণ আদালতে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৩১,৩০৯ মামলার বিচার চলছিল। এসব মামলার সঙ্গে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জড়িত। ১০,২১১ মামলায় জামিনদারও বিবাদী। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১,১২৯ মামলার রায় হয়েছে, জড়িত প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে ৪০৮ মামলায় গ্যারান্টারও বিবাদী ছিলেন। ২০২৪ সালে রায় হয়েছে ৯৩৯ মামলায়, ২৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ জড়িত। এর মধ্যে ২৭৬ মামলায় গ্যারান্টারও বিবাদী। ২০২৩ সালে রায় হয়েছে ৪২৮ মামলায়, ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ জড়িত। ৩৭৮ মামলায় গ্যারান্টার বিবাদী।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত হাইকোর্টে ৭৪৮টি রিট করা হয়েছে, জড়িত প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ৫৫৪ জনের নাম সিআইবি থেকে স্থগিত। ২০২৪ সালে ১,২৩৫টি রিট হয়, জড়িত প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ৮৬৬ জনের নাম স্থগিত করা হয়। নিলাম ঠেকাতে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৩১টি রিট করা হয়, জড়িত প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকার ঋণ। ১৩৯টি নিলাম স্থগিত। ২০২৪ সালে নিলাম ঠেকাতে ৪৫৮টি রিট হয়, জড়িত প্রায় ৭,৫০০ কোটি টাকার ঋণ। ১৭৯ নিলাম স্থগিত।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এমরান আহমেদ ভুঁইয়া বলেন, “একটি ঋণের বিপরীতে ব্যাংক যথেষ্ট বন্ধক নিতে পারলে গ্যারান্টর নেওয়া প্রয়োজন নেই। গ্যারান্টর বানিয়ে অহেতুক হয়রানি মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাই আইন সংশোধনের সময় এসেছে।”

