টিভি বিজ্ঞাপন এবং নকশিকাঁথা ক্রয়ের ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে নাম রয়েছে সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) ওয়ারেস উল মতিনসহ কয়েকজন কর্মকর্তার।
ব্যাংকের করা অভিযোগ অনুযায়ী, টিভি বিজ্ঞাপনের নামে ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা, আর ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকদের উপহার দেখিয়ে ছয় হাজার ৩৫০টি নকশিকাঁথার জন্য এক কোটি ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। তাছাড়া লজিস্টিকস ক্রয়ের নামেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ওয়ারেস উল মতিনসহ ছয়জনকে আদালতে মামলা করেছে ব্যাংক। পাশাপাশি চারটি অভিযোগ দুদকে পাঠানো হয়েছে।
ওয়ারেস উল মতিন ছিলেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। তিন বছর স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর ২০১২ সালে তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকে যোগ দেন এভিপি পদে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের ছায়া প্রভাবের কারণে তিনি ক্রমে প্রভাবশালী হন। অভ্যুত্থানের পর চট্টগ্রামে বদলি হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, সিএসআর, করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, প্রায়োরিটি ব্যাংকিং, লজিস্টিকস, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, ওয়ারেস উল মতিন এই ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ওয়ারেস উল মতিন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর অভিযোগ আনা হয়েছে। সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি হাইকোর্টে রিট করেছি। সুষ্ঠু তদন্ত চাই। অপরাধ করলে তদন্ত চাইতাম না।”
দুদকে পাঠানো অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, জন্মবার্ষিকী, মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন, ব্র্যান্ডিংয়ের নামে টিভি বিজ্ঞাপনের জন্য ২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। বিজ্ঞাপন প্রচার দেখানো হয়েছে বেসরকারি চ্যানেল বাংলাভিশন, মাই টিভি, এনটিভি, মাছরাঙা, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই ও একুশে টেলিভিশনে। কিন্তু অন্তত চারটি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন আসেনি। নিরীক্ষায় দেখা যায়, বিজ্ঞাপন প্রচার দেখানোর জন্য ইনবক্স কমিউনিকেশন নামের প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়েছে। মালিক ওমর শরীফ ভূঁইয়া। করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও সিএসআর বিভাগের অধিকাংশ বিজ্ঞাপনের খরচের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান যুক্ত।
ব্যাংকের ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন করে ২১ কোটি টাকা খরচ করা হয়। উৎসে কর ও ভ্যাট কর্তন শেষে ১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ইনবক্স কমিউনিকেশনকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে দেওয়া হয়। নিরীক্ষায় দেখা গেছে, টাকা প্রথমে প্রিন্সিপাল শাখায় জমা হয়, পরে নগদে তোলা হয়। অভ্যন্তরীণ জিজ্ঞাসাবাদে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, ইনবক্স কমিউনিকেশনের মালিককে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অফিসে কখনও দেখা হয়নি। সব কার্যক্রম সমন্বয় করেছেন সাবেক এসইভিপি ওয়ারেস উল মতিন।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে ছয় হাজার ৩৫০টি নকশিকাঁথা কেনার নামে এক কোটি ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আসে। ৯টি অস্তিত্বহীন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া বিল তৈরি করা হয়। ব্যাংকের যাচাইয়ে দেখা যায়, আটটির অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি, আর একটির মালিকও দাবি করেছেন কোনো নকশিকাঁথা সরবরাহ করেননি।
২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৮ শাখার জন্য চেয়ার, সাইনবোর্ড, বৈদ্যুতিক ও সিলিং মেরামত এবং ব্র্যান্ডিংয়ের নামে তিন কোটি ৬৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা তোলা হয়। বাস্তবে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা ছাড়া অন্য কোথাও কাজ হয়নি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের নিবন্ধিত ঠিকাদার ছিল না। অনুমোদনপত্র যাচাইয়ে দেখা যায়, পাঁচ কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।
ব্যাংক জানিয়েছে, ওয়ারেস উল মতিনের নির্দেশে মশীয়ুর রহমান ও জাহিদের মাধ্যমে পে-অর্ডার ও চেকের মাধ্যমে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সাবেক কর্মকর্তারা ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ বিষয়ে দুদকে অভিযোগের পাশাপাশি ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জজ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির জানিয়েছেন, প্রথমে বিষয়টি জানতেন না, পরে জেনেছেন। সিসি ক্যামেরা বসানোর অনুমতি তিনি দিয়েছিলেন। ওয়ারেস উল মতিন বলেন, সিসিটিভি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের ভিত্তিতে বসানো হয়েছিল।