দেওয়ানী মামলা হলো এমন এক ধরনের আইনি প্রক্রিয়া যেখানে ব্যক্তিগত অধিকার, সম্পত্তি বা আর্থিক ক্ষতির জন্য আদালতে মামলা করা হয়। এই মামলাগুলো সাধারণত চুক্তিভঙ্গ, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ, পারিবারিক বিষয় (যেমন – দেনমোহর, ভরণপোষণ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের হেফাজত) এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য করা হয়ে থাকে। দেওয়ানী মামলার বিচার প্রক্রিয়া দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ (Code of Civil Procedure, 1908) দ্বারা পরিচালিত হয়
সমন জারি: মামলা দায়েরের পর প্রথম ধাপ হলো সমন জারি। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমন জারি না হলে মামলার কার্যক্রম শুরু হয় না। সমন হলো সেই নোটিশ যা দিয়ে বিবাদীকে জানানো হয় যে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেক সময়ই সমন ঠিকমতো জারি না হওয়ায় মামলা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায়।
ইস্যু গঠন: প্রথম শুনানীর পর আদালত নির্ধারণ করেন মামলার বিরোধীয় বিষয়গুলো কী কী। কেবল এই বিষয়গুলোর ওপরই মামলার বিচার হবে। ইস্যু গঠন হয়ে গেলে মামলা আরও স্পষ্টভাবে দু’পক্ষের বিতর্কিত বিষয়গুলোর ভিত্তিতে এগোতে পারে।
উদঘাটন ও পরিদর্শন: ইস্যু গঠনের পর বাদী বা বিবাদী আদালতের অনুমতি নিয়ে একবার লিখিত প্রশ্নাবলী দাখিল করতে পারেন। এই ধাপে পক্ষগুলো তথ্য ও দলিল যাচাই করেন। এটি মামলার প্রমাণ সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৩০ ধারার তদ্বির: এই পর্যায়ে আদালত নির্ধারিত শর্ত ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে যেকোনো তথ্য, দলিল বা সাক্ষ্য গ্রহণের আদেশ দিতে পারেন। এটি আদালতের নিজ উদ্যোগে বা কোনো পক্ষের আবেদন অনুযায়ী হতে পারে। এছাড়া আদালত চাইলে দলিল পরিদর্শন, উপস্থাপন, আটক বা ফেরত সংক্রান্ত আদেশও দিতে পারেন।
চূড়ান্ত শুনানি: এরপর চূড়ান্ত শুনানীর তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এই ধাপে বিচারক বাদী ও বিবাদীর জবানবন্দী গ্রহণ করেন, দলিলাদি যাচাই করেন এবং সাক্ষীদের জেরা করেন।
যুক্তিতর্ক ও রায়: চূড়ান্ত শুনানীর পরে আদালত উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনেন। যুক্তিতর্ক হলো সেই সময় যখন বাদী ও বিবাদীর আইনজীবীরা আদালতের সামনে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করেন। তারা ব্যাখ্যা করেন কেন তাদের দাবি বা প্রতিকার মেনে নেওয়া উচিত, এবং কেন অন্যপক্ষের দাবিটি খারিজ করা উচিত।
- যুক্তিতর্কের সময় আদালত দুটি বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল করেন: পূর্ববর্তী ধাপে জমা দেওয়া দলিল ও প্রমাণ। সাক্ষীদের দেয়া তথ্য এবং আদালতে উত্থাপিত বিরোধীয় বিষয়।
- পক্ষগুলোর যুক্তি শেষ হওয়ার পর বিচারক সব তথ্য ও প্রমাণ যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায় হলো মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, যা মামলার দাবি পূরণ বা প্রত্যাখ্যানের কথা নির্ধারণ করে। রায়ের সঙ্গে ডিক্রি প্রদানও হয়। ডিক্রি হলো আদালতের লিখিত আদেশ, যা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং যার ভিত্তিতে আদালত প্রয়োজনে সম্পত্তি, টাকা বা অন্য প্রকার কার্যাদেশ জারি করতে পারেন।
মোটামুটি একটি দেওয়ানী মামলা ১২ থেকে ১৩টি ধাপ বা স্তরের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। একটি ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে যেতে সাধারণত কমপক্ষে দুই মাস সময় লাগে। তাই সাধারণ হিসাব অনুযায়ী, এক মামলার শুরু থেকে শেষ হতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগে, কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল। যার বিরুদ্ধে রায় আসে, তিনি জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। এই আপিল নিষ্পত্তিতে কমপক্ষে দুই বছর লাগে। এরপর হারে সেই পক্ষ হাইকোর্টে রিভিশন করেন, যেখানে আরও কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগে। হাইকোর্টে হেরে গেলে আপিল বিভাগে যান, যা আরও তিন বছর সময় নেয়। এই হিসাব অনুযায়ী, চূড়ান্তভাবে একটি মামলা শেষ হতে ১০–১২ বছর লেগে যায়।
এর চেয়ে বাস্তব জটিলতা আরও বড়। কখনও আদালত এমন আদেশ দেন, যার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে এক পক্ষ উচ্চ আদালতে রিভিশন করেন। তখন মূল মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে এবং নিম্ন আদালতে কার্যক্রম স্থগিত হয়। এছাড়া উভয় পক্ষ সময়ের আবেদন, সাক্ষী দেরি আনা বা সমন জারি না হওয়ার কারণে মামলা আরও দীর্ঘায়িত হয়। অনেক সময় সমন ঠিকমতো জারি না হওয়ার কারণে মামলাটি বছরের পর বছর শুরুও হয় না। সার্বিকভাবে, দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তি হতে এত বেশি সময় লাগে মূলত প্রক্রিয়ার জটিলতা, আদালতের ধীরগতি এবং পক্ষগুলোর দেরি এর কারণে।

