খুব সহজভাবে বলতে গেলে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামা হলো কোনো ব্যক্তিকে অন্যের পক্ষে নির্দিষ্ট কাজ করার ক্ষমতা প্রদান অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি অন্যজনকে লিখিতভাবে ক্ষমতা দেন যেন তিনি তাঁর পক্ষে নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করতে পারেন।
এ ধরনের দলিলের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে যাঁরা বিদেশে থাকেন বা বিদেশে যাচ্ছেন, অথচ দেশে তাঁদের সম্পত্তি রয়েছে। ধরুন, আপনি প্রবাসে আছেন, কিন্তু দেশে জমিজমা আছে যেগুলো আপনি নিজে গিয়ে দেখাশোনা করতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে আপনি কাউকে সেই সম্পত্তি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ বা বিক্রির ক্ষমতা দিতে পারেন। শুধু জমিজমা নয়, আপনার অনুপস্থিতিতে অন্যান্য আইনগত বা প্রশাসনিক কাজও অন্যকে দিয়ে করানো যায় এই পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ১৮৮২ সালের পুরনো আইন রহিত করে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইন, ২০১২’ প্রণয়ন করা হয়, যা ১ জুলাই ২০১৩ থেকে কার্যকর। এই আইনে বলা হয়েছে—পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হলো এমন একটি দলিল, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি আইনসম্মতভাবে অন্য কাউকে তাঁর পক্ষে নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা দেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা দেওয়া যায় না। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালা, ২০১৫-এর বিধি ৪ অনুযায়ী উইল তৈরি বা নিবন্ধন, দত্তক গ্রহণের ক্ষমতাপত্র, দান ও হেবা ঘোষণা, ট্রাস্ট দলিল বা সরকারের ঘোষিত বিশেষ দলিলের ক্ষেত্রে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি প্রযোজ্য নয়।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদনের নিয়ম:
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অবশ্যই লিখিত দলিল হতে হবে। এর মাধ্যমে যাকে মোক্তার বা অ্যাটর্নি করা হয়, তিনি মালিকের পক্ষে দান, বিক্রি, হস্তান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ, খাজনা আদায় বা বন্ধক রাখাসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারেন। দলিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে তিনি কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সাধারণত দুই প্রকার:
১. সাধারণ মোক্তারনামা (আমমোক্তারনামা): এতে মোক্তারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়।
২. বিশেষ মোক্তারনামা: নির্দিষ্ট কাজের জন্য দেওয়া হয়।
যেসব মোক্তারনামা জমিজমা হস্তান্তরের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেগুলো নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নোটারি করলেই যথেষ্ট। তবে জমিজমা-সংক্রান্ত দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়, না হলে এর আইনি বৈধতা থাকে না। দলিল সম্পাদনের তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। কোনো মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রেও অ্যাটর্নি নিয়োগ করা যায়, তবে এতে আদালতের অনুমতি প্রয়োজন। দলিলের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে এটি সম্পাদন করতে হয়। বর্তমানে দলিলে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ছবি থাকা বাধ্যতামূলক।
প্রবাসীরা যেভাবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করবেন:
বিদেশে অবস্থানরত কেউ যদি বাংলাদেশে কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে চান, তবে আইন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি। তাঁকে দলিলটি লিখে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রত্যয়ন করাতে হবে। এরপর দলিলটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব কর্তৃক সত্যায়ন করতে হবে। পরবর্তী ধাপে এটি জেলা প্রশাসকের রাজস্ব কার্যালয়ে জমা দিয়ে স্ট্যাম্প লাগাতে হবে। সেখানেই দলিলের ক্রমিক নম্বর ও তারিখ নির্ধারিত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—যাকে মোক্তার করা হচ্ছে, তিনি যেন বিশ্বস্ত হন। অনেক সময় প্রতারণার মাধ্যমে মোক্তার নিজের নামে সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। তাই দলিলের শর্তগুলো স্পষ্টভাবে লেখা ও মোক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিলের নিয়ম:
যেকোনো সময় সাধারণ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল করা যায়। বাতিল করতে হলে যে রেজিস্ট্রি অফিসে এটি করা হয়েছিল, সেখানকার জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করতে হয়। নোটারি করা দলিল হলে সেটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমেই বাতিল করতে হয়। দাতা যদি বাতিল করতে চান, তবে গ্রহীতাকে রেজিস্টার্ড ডাকের মাধ্যমে ৩০ দিনের নোটিশ দিতে হবে। একইভাবে গ্রহীতাও চাইলে মালিককে ৩০ দিনের নোটিশ দিয়ে দায়িত্ব ত্যাগ করতে পারেন।
নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য করা মোক্তারনামা মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়। নির্দিষ্ট কাজের জন্য করা মোক্তারনামাও কাজ সম্পন্ন হলে বাতিল বলে গণ্য হবে। যৌথ মোক্তারনামার ক্ষেত্রে পক্ষদের একজন মারা গেলে সেটিও বাতিল হয়ে যায়। মোক্তারনামা বাতিলের পর রেজিস্ট্রার বিষয়টি জেলার অন্যান্য রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিশ আকারে পাঠান। ডাক টিকিটের খরচ আবেদনকারীকে বহন করতে হয়।
রেজিস্ট্রিকৃত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি থেকে কোনো বিরোধ সৃষ্টি হলে পক্ষরা প্রথমে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবেন। ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতাকারীর সহায়তা নিতে পারেন। তাতেও সমাধান না হলে আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালা, ২০১৫-এর বিধি ১২ ও ১৩ অনুযায়ী, বাতিল বা অবসানের ক্ষেত্রে পক্ষ বা তাঁদের প্রতিনিধি নির্ধারিত ফরমে নোটিশ দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে নথিভুক্ত করবেন।