সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে প্রায় এক বছর ধরে সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ ছিল। বিগত সরকারের সময়ে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর নতুন নিয়োগবিধি সংশোধনের কাজ শুরু হওয়ায় এই অচলাবস্থা তৈরি হয়। বর্তমানে আদালতগুলোতে তিন হাজারের বেশি পদ শূন্য। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী এসব নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএসসি)-এর হাতে।
গতকাল সোমবার আইন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত নিয়োগবিধি প্রজ্ঞাপন জারির জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, রাতেই বা আজ মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। বিগত সরকারের সময়ে অধস্তন আদালতের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের অনিয়ম ঘটেছিল। অভিযোগ ওঠে, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশে গঠিত সিন্ডিকেট জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে নিয়োগ পাওয়া তিন হাজারের বেশি কর্মচারীর বড় অংশ এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা থেকে, যা সাবেক মন্ত্রীর নিজ এলাকা। ফলে আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। অনেক নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি ন্যূনতম কাজও জানতেন না। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আইন মন্ত্রণালয় এসব অনিয়ম নিয়ে তদন্ত শুরু করে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখে হতবাক হন। পরে নিয়োগবিধি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা জেলা জজদের থেকে তুলে নিয়ে কমিশনের হাতে দেওয়া হয়েছে।
কোন বিধিমালা সংশোধন হলো: দুটি নিয়োগবিধি সংশোধন করা হয়েছে:
১. জেলা জজ ও অধস্তন আদালত (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯
২. জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮
আগে নিয়োগের জন্য অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ ও সিনিয়র সহকারী জজ একটি কমিটি গঠন করতেন। তারা প্রার্থী বাছাই করে জেলা জজের কাছে সুপারিশ পাঠাতেন। জেলা জজ চূড়ান্ত নিয়োগ দিতেন। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ব্যাপক দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন চলত।
নতুন বিধিতে কী থাকছে: নতুন বিধিতে বলা হয়েছে—
- সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা জজ হবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।
- প্রার্থী বাছাই করবে জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন।
- কমিশন লিখিত, ব্যবহারিক (যদি প্রযোজ্য) ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করবে।
- বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা জেলা জজের কাছে পাঠানো হবে। জেলা জজকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে।
- কোনো পদ শূন্য হলে এক মাসের মধ্যে জেলা জজকে তা কমিশনের কাছে জানাতে হবে।
- কমিশন বছরে এক বা একাধিকবার কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবে।
- প্রয়োজন হলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞসহ বোর্ড গঠন করা যাবে।
একটি বিশেষ বিধান অনুযায়ী নিয়োগবিধি সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সময় যে সরাসরি নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল, যদি লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন না হয়ে থাকে, তবে সব আবেদন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে। কমিশন তা বাছাই করবে এবং নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রয়োজন হবে না। বিচারক ও আইনজীবী মহলে এই পদক্ষেপকে “যুগান্তকারী” বলা হচ্ছে। একাধিক বিচারক মনে করেন, “বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষায় পদক্ষেপটি সময়ের দাবি ছিল। ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য কর্মচারীদের কারণে বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।”
বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা কমিশনের মাধ্যমে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আশা করি দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ হলে বিচারপ্রার্থীদের প্রত্যাশিত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।” সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী এখন থেকে আদালতের নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও কেন্দ্রীভূত। এতে অদক্ষ নিয়োগ বন্ধ হবে এবং বিচার বিভাগের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।