কোর্ট কাচারিতে বা আমাদের সমাজে ‘অগ্রক্রয়’ বিষয়ক মামলা অনেক আগেই পরিচিত। তবে আধুনিক ব্যবহারিক ভাষায় ‘প্রি-এমশন’ শব্দটি বেশি প্রচলিত। আজ আমরা জানবো, অগ্রক্রয় কী, কে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারে এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য।
অগ্রক্রয়ের মামলা কি?
অগ্রক্রয়ের মামলা হলো একটি আইনি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জমির সহ-অংশীদার বা সংলগ্ন জমির মালিক কোনো বহিরাগত ব্যক্তির কাছে বিক্রি হওয়া জমি প্রথমে নিজে কিনে নেওয়ার দাবি করতে পারেন। এই অধিকারটি মুসলিম আইন ও বাংলাদেশের ভূমি আইনে স্বীকৃত, যা মূলত জমির নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখা ও মালিকানা নিয়ে বিবাদ কমানোর উদ্দেশ্যে প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশে সাধারণত তিন ধরনের অগ্রক্রয় হয়:
১. রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, সংশোধনী ২০০৬, ধারা ৯৬ অনুসারে
২. অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন, ধারা ২৪ অনুসারে
৩. মুসলিম আইনের বিধান অনুযায়ী
অগ্রক্রয়ের আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এটি নিশ্চিত করে, উত্তরাধিকারী বা নির্দিষ্ট ব্যক্তি তার বৈধ সম্পত্তি প্রথমে কিনতে পারে। ফলে কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি অন্যকে অযাচিতভাবে প্রতিহত করতে পারবে না।
কারা অগ্রক্রয়ের আবেদন করতে পারেন?
‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধনী ২০০৬) ধারা ৯৬ অনুযায়ী, যদি কেউ উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরিক হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি প্রি-এমশন বা অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারবেন। উত্তরাধিকার ছাড়া ক্রয়সূত্রে অংশ নেওয়া বা অন্যান্য সহ-শরীকরা এই আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারবেন না। ২০০৬ সালের আগে অন্য সহ-শরীকরা এই আইনের অধীনে মামলা করতে পারতেন। কিন্তু ২০০৬ সালের সংশোধনের পর শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে যারা সহ-শরীক, তারা কেবল এ আইনে প্রতিকার পাবেন।
কৃষি জমি বিক্রয়ের বিরুদ্ধে অগ্রক্রয়ের মামলায় যে শর্ত মানতে হয়:
কৃষি জমি বিক্রি হলে অগ্রক্রয়ের অধিকার ব্যবহার করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মানতে হয়। প্রথমেই জমি বিক্রির আগে রেজিস্ট্রেশন আইন ধারা ৮৯ অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরীকদের নোটিস দেওয়া বাধ্যতামূলক। নোটিস পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে হবে।
যদি নোটিস না দেওয়া হয় এবং জমি গোপনে বিক্রি হয়, তাহলে বিক্রয়ের বিষয়টি জানা যাওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। তবে বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার তিন বছরের মধ্যে মামলা না করলে আর মামলা করার অধিকার থাকবে না। অর্থাৎ, দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার তিন বছরের পর যদি আপনি বিক্রির বিষয়টি জানতে পারেন, তখন মামলা করার সুযোগ থাকবে না। মামলায় যতজন উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরীক রয়েছে এবং যতজন ক্রেতা সংশ্লিষ্ট জমিতে আছে, সবাইকে আদালতে পক্ষভুক্ত করতে হবে। মামলা দাখিলের সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হয়। এই অর্থ হলো বিক্রয় দলিলে উল্লেখিত বিক্রয়মূল্য। এছাড়া বিক্রয় দলিলে থাকা টাকার ২৫% হারে ক্ষতিপূরণ এবং দলিলের তারিখ থেকে মামলার দাখিল পর্যন্ত বার্ষিক ৮% হারে সরল সুদ আদালতে জমা দিতে হবে।
আবেদন এবং অর্থ জমা দেওয়ার পর আদালত প্রতিপক্ষকে নোটিশ দিয়ে ক্রেতাসহ সব শরীককে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। আদালত প্রয়োজনমতো ক্রেতার খাজনা ও অন্যান্য খরচও জানতে পারেন। সব কিছু পর্যালোচনা করার পর আদালত আবেদনকারীকে জমি কেনার অধিকার দিতে পারেন। এর পর জমা দেওয়া টাকা থেকে ক্রেতাকে তার পাওনা পরিশোধ করতে নির্দেশ দেন। আদালত মঞ্জুর করলে ৬০ দিনের মধ্যে বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করতে হবে। এই রেজিস্ট্রেশনের জন্য কোনো কর, ডিউটি বা ফি দিতে হয় না। ৬০ দিনের মধ্যে যদি দলিল রেজিস্ট্রি না হয়, আদালত পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে তা সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগও আইনে রাখা আছে।
অকৃষি জমির ক্ষেত্রে:
অকৃষি জমি বলতে বোঝায় কৃষিজমি নয় এমন জমি, যেমন বসতভিটা, আবাসিক এলাকা, শিল্পভিত্তিক জমি। এই ধরনের জমিতে সহ-শরীকরা অগ্রক্রয়ের অধিকার ব্যবহার করতে পারেন। তবে এখানে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরীক হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ১৯৪৯-এর ধারা ২৪ অনুযায়ী, ক্রয়সূত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে সহ-শরীকরা অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। জমি রেজিস্ট্রির সময় ধারা ২৩ অনুযায়ী নোটিস দেওয়ার নিয়ম আছে। নোটিস পাওয়ার বা জমি বিক্রয়ের খবর জানা হলে চার মাসের মধ্যে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে হবে। পাশাপাশি বিক্রয় দলিলে উল্লেখিত টাকার সঙ্গে ৫% হারে ক্ষতিপূরণ আদালতে জমা দিতে হবে।
কিছু ক্ষেত্রে, ক্রেতা জমিতে দালান-কোঠা তৈরি করে ফেললে আদালত সেই কাজের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আদালত সময়সীমা নির্ধারণ করবেন। এছাড়া পৌর এলাকার যে কোনো জমি সব সময় অকৃষিজমি হিসেবে গণ্য হবে। এই ধরনের জমির জন্য প্রজাস্বত্ব আইনের ধারা ৯৬ অনুযায়ী মামলা করা যাবে না। মুসলিম আইনে দেখা যায়, কোনো জমিতে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরীক না থাকলেও অন্যান্য সহ-শরীকরা অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারবেন। মুসলিম আইনে তিন ধরনের ব্যক্তি এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন—শফিই শরীক, শফিই খালিত এবং শফিই জার। প্রজাস্বত্ব আইনের ধারা ৯৬ অনুযায়ী শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-শরীকরা মামলা করতে পারেন, কিন্তু মুসলিম আইনে সব সহ-শরীক মামলা করতে পারবেন। এটিকেই ‘শুফা’ অধিকারের মামলা বলা হয়।
তবে কিছু ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে অগ্রক্রয় প্রযোজ্য হয় না। যেমন—হেবাকৃত সম্পত্তি, উইলকৃত সম্পত্তি, দেবোত্তর বা ওয়াকফকৃত জমি, খাই-খালাসি বন্ধকের মাধ্যমে জমি হস্তান্তর, আপসমূলে ডিক্রিপ্রাপ্ত জমি। তবে রক্ত সম্পর্ক ছাড়া অন্য কারও বরাবর হেবা করা হলে সেই সম্পত্তিতেও অগ্রক্রয়ের মামলা করা যাবে। এছাড়া যাদের ৬০ বিঘা জমি রয়েছে, তারা অগ্রক্রয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। ৬০ বিঘার কম জমির ক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো সেই সীমার মধ্যে অগ্রক্রয় প্রযোজ্য হবে।
অগ্রক্রয় বা প্রি-এমশন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি অধিকার, যা নিশ্চিত করে উত্তরাধিকারী বা নির্দিষ্ট সহ-শরীকরা স্থাবর সম্পত্তি প্রথমে কিনতে পারে। কৃষি, অকৃষি বা মুসলিম আইনের বিভিন্ন বিধান অনুযায়ী এই অধিকার প্রয়োগের নিয়ম আলাদা। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমা, নোটিস ও আর্থিক শর্ত মেনে চলা আবশ্যক। সঠিকভাবে অগ্রক্রয় ব্যবহার করলে কেউ অন্যের অধিকার হরণ করতে পারবে না এবং সম্পত্তি ক্রেতা-সহ-শরীকদের মধ্যে স্বচ্ছভাবে বিন্যস্ত হবে। এভাবে অগ্রক্রয় আমাদের সম্পত্তি সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম হিসেবে কাজ করে।