বাংলাদেশে জমি নিয়ে বিরোধ দেশের অন্যতম জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তিগত আমিন বা দালালের মাধ্যমে জমি মাপার প্রবণতা এখনো প্রচলিত। তবে এতে প্রায়ই দেখা যায় দুর্নীতি, ভুল মাপঝোক বা পক্ষপাতিত্ব, যার ফলে একই জমি নিয়ে একাধিক মামলা আদালতে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
এই জটিল বাস্তবতায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের উদ্যোগে জমি মাপঝোক ও আপোষ মীমাংসা এখন একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও আইনসম্মত সমাধান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিস একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যা “জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ অনুসারে পরিচালিত হয়। এখানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সাধারণত সিনিয়র সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলা জজ, যাঁরা পেশাদার বিচারক হিসেবেই কাজ করেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে জমি মাপঝোক কার্যক্রমের আইনি গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের স্বাক্ষরযুক্ত আপোষনামা বা চুক্তিপত্র সিভিল কোর্টের ডিক্রীর সমান কার্যকর, যা ভবিষ্যতে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা প্রায় অসম্ভব।
প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ:
- আবেদন ও কাগজপত্র দাখিল: বিরোধী পক্ষগুলো নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (দলিল, খতিয়ান, ম্যাপ, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি) জমা দেন। এতে বিরোধের ধরন ও পরিধি স্পষ্ট হয়, আর প্রক্রিয়া শুরু হয় যাচাইযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে।
- আপোষ প্রক্রিয়া: প্রতিপক্ষকে নোটিশ দিয়ে আলোচনায় ডাকা হয়। উভয়পক্ষ সম্মত হলে একজন সার্ভেয়ার নিয়োগ দেওয়া হয়। সবকিছুই পক্ষগণের অংশগ্রহণে সম্পন্ন হয়, ফলে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও অংশীদারিত্বমূলক হয়।
- মাপঝোক কার্যক্রম: অনুমোদিত প্যানেলভুক্ত সার্ভেয়ার সরেজমিনে জমি মাপেন। উভয়পক্ষকেই উপস্থিত থাকতে বলা হয়, যাতে পক্ষপাত বা গোপন তথ্যের সুযোগ না থাকে।
- প্রতিবেদন প্রদান ও নথিভুক্তি: মাপঝোক শেষে সার্ভেয়ার একটি লিখিত প্রতিবেদন জমা দেন। আবেদনকারী ও প্রতিপক্ষ উভয়ে এর কপি পান, আর মূল নথি অফিসে সংরক্ষিত থাকে। এটি ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে কার্যকর দলিল হয়।
- আপত্তি ও চূড়ান্ত মীমাংসা: যদি কোনো পক্ষ আপত্তি জানায়, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার প্রয়োজনে সরেজমিন তদন্ত করেন বা নতুন সার্ভেয়ার নিয়োগ দেন। সমাধান পাওয়ার পর উভয়পক্ষের সম্মতিতে একটি আপোষনামা তৈরি হয়, যা আদালতের ডিক্রীর সমান ক্ষমতাসম্পন্ন।
সুবিধাগুলো:
- আইনি বৈধতা: সমাধান আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য। একবার নিষ্পত্তি হলে নতুন করে মামলা করার প্রয়োজন পড়ে না।
- দুর্নীতি প্রতিরোধ: ব্যক্তিগত আমিন বা দালালের মাধ্যমে অনিয়মের ঝুঁকি থাকে না।
- খরচ ও সময় সাশ্রয়: প্রায় বিনা খরচে দ্রুত সমাধান পাওয়া যায়।
- বিশ্বাসযোগ্যতা: অভিজ্ঞ বিচারক ও অনুমোদিত সার্ভেয়ারের তত্ত্বাবধানে কাজ হয়, তাই নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
- দীর্ঘমেয়াদী সমাধান: প্রতিবেশীর সঙ্গে জমি বিরোধ আইনি ও আপোষমূলকভাবে নিষ্পত্তি হয়।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে জমি মাপঝোক ও মীমাংসা শুধু প্রশাসনিক বা বিচারিক নয়—এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি আধুনিক ও টেকসই পদ্ধতি। এতে জমি সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত ও স্থায়ীভাবে সমাধান হয়, জনগণ দালালচক্রের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং আদালতের মামলা জটও কমে। জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সূত্র: ল’ ইয়ার্স ক্লাব