বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালতে ঋণ বা আর্থিক প্রতারণা সম্পর্কিত মামলা একটি সাধারণ বিষয়। ব্যবসায়িক লেনদেন, ঋণ-দেনা, ব্যাংকিং লেনদেন, অংশীদারি ব্যবসা, সাপ্লাই চুক্তি, বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার বা ঠিকাদারি চুক্তি থেকে শুরু করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ—সবই আর্থিক বিরোধের মূল উৎস। এ ধরনের মামলাকে “মানি সুট” বলা হয়।
তবে অনেক ক্ষেত্রে বাদী দেরিতে মামলা দায়ের করেন। তখনই মামলা “তামাদি” বা সময়সীমা অতিবাহিত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে বহু সত্যিকারের দাবি আইনি পথে সফল হয় না। এই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে তামাদি আইন ও তার প্রভাব, এবং কীভাবে বাদী আইনি কৌশল অবলম্বন করে প্রতিকার পেতে পারেন।
বাংলাদেশের তামাদি আইন, ১৯০৮ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়। ধারা ৩ অনুযায়ী, যদি মামলা তামাদির মধ্যে পড়ে, আদালত নিজ উদ্যোগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা খারিজ করতে পারে। আইনের উদ্দেশ্য হলো আদালতের অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘসূত্রতা কমানো এবং পক্ষদ্বয়কে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করা।
তামাদি আইন, ১৯০৮-এর তফসিল ১, অনুচ্ছেদ ৫৭ অনুযায়ী, চুক্তিভিত্তিক বা ঋণ-সংক্রান্ত দাবির ক্ষেত্রে সময়সীমা ৩ বছর। সময় গণনা শুরু হয় চুক্তি লঙ্ঘনের দিন বা অর্থ ফেরতের অস্বীকারের দিন থেকে। এখানে Cause Of Action বোঝায়, দাবি কার্যকর করার আইনগত অধিকার যখন প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধার নেওয়া টাকা ফেরত না দেওয়ার দিন থেকেই তামাদি সময় গণনা শুরু হবে।
ধারা ১৮, ১৯ ও ২০:
প্রতারণা – ধারা ১৮: যদি প্রতিপক্ষ প্রতারণা করে বা দাবির বিষয় গোপন রাখে, এবং বাদী তা পরে জানতে পারেন, তাহলে তামাদি সময় নতুন করে শুরু হয় প্রতারণা আবিষ্কারের দিন থেকে। তবে প্রমাণ অবশ্যই নির্ভরযোগ্য হতে হবে।
লিখিত স্বীকৃতি – ধারা ১৯: যদি কোনো ব্যক্তি লিখিতভাবে দায় স্বীকার করেন, স্বীকৃতির তারিখ থেকে নতুন তিন বছরের সময় গণনা শুরু হয়। উদাহরণ: ১ জানুয়ারি ২০২৩-এ ঋণ নেওয়া হলে মামলাটি ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে করতে হতো। কিন্তু যদি ১ জুলাই ২০২৫-এ লিখিত স্বীকারোক্তি আসে, “আমি তোমার ৫০,০০০ টাকা ফেরত দিতে পারিনি”, তাহলে নতুন ৩ বছর শুরু হবে।
আংশিক অর্থ প্রদান – ধারা ২০: যদি দায়ী ব্যক্তি আংশিক টাকা বা সুদের অর্থ প্রদান করেন এবং লিখিতভাবে স্বাক্ষর থাকে, তাহলে নতুন সময় গণনা শুরু হয়। শর্ত, পরিশোধ তামাদি সময়সীমার মধ্যেই হতে হবে। মৌখিক স্বীকারোক্তি, সাক্ষী বা ফোনালাপ গ্রহণযোগ্য নয়।
তামাদি হলেও মামলা করার কৌশল:
দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮, আদেশ VII, বিধি ৬: বাদী যদি আবেদন করেন যে মামলা তামাদি হলেও “তামাদি থেকে অব্যাহতি” প্রযোজ্য, আদালত বিবেচনা করতে পারেন।
নতুন স্বীকৃতি বা আংশিক পরিশোধ: আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে লিখিত নোটিশ পাঠিয়ে স্বীকৃতি বা আংশিক পরিশোধ আদায় করলে নতুন Cause Of Action তৈরি হয়।
প্রতারণা বা স্বীকৃতি:
- প্রতিপক্ষ প্রতারণা করলে সময় নতুনভাবে শুরু হয়।
- লিখিত স্বীকারোক্তি পাওয়া গেলে সময় পুনর্গণনা হয়।
- আংশিক টাকা বা সুদ ফেরত দিলে লিখিত ও স্বাক্ষরিত প্রমাণ থাকলে সময় নতুন হয়।
কিছু বাদী মিথ্যা তথ্য বা স্বীকৃতি দেখিয়ে আইনি সীমাবদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা করেন। এ ধরনের কাজ ধারা ১৯৩, ১৯৯ ও ২০০ অনুযায়ী মিথ্যা শপথ হিসেবে দণ্ডনীয়। এর ফলে ফৌজদারি মামলা, অর্থদণ্ড বা কারাদণ্ড হতে পারে। তাই আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী সততা ও সত্যতা মেনে চলা জরুরি।
বিকল্প কৌশল:
- ADR বা সালিশি – মধ্যস্থতা বা সমঝোতার মাধ্যমে টাকা আদায় করা।
- নতুন চুক্তি বা স্বীকারোক্তি – লিখিত স্বীকৃতি আদায় করলে নতুন তামাদি সময় শুরু হয়।
- ফৌজদারি অভিযোগ – গুরুতর প্রতারণার ক্ষেত্রে ধারা ৪২০ বা ৪০৬ অনুযায়ী মামলা দায়ের করা যেতে পারে। তবে দেওয়ানি দাবির জন্য ফৌজদারি মামলা অপব্যবহার করা উচিত নয়।
বাংলাদেশের তামাদি আইন কখনও কখনও ন্যায়বিচারে বাধা দিতে পারে, আবার দীর্ঘসূত্রতা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও দেয়। তবে সচেতনতা, আইনজীবীর পরামর্শ এবং সময়মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে আইনের মধ্যেই প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। মিথ্যা তথ্য, জাল স্বীকারোক্তি বা চাপ প্রয়োগ আইনের পরিপন্থী। সততা, সময়মতো পদক্ষেপ ও কৌশলী আইনি ব্যবস্থা মানি সুটে সফলতার চাবিকাঠি।