প্রায় সময় দেশের অধস্তন আদালতে বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির সিদ্ধান্তে আদালত বর্জনের ঘটনা ঘটে। এটি আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। বর্জনের কারণ বিভিন্ন হতে পারে, তবে তা কখনো কাম্য নয়। আদালত বর্জনের ফলে সংশ্লিষ্ট বিচারককে বিচার কার্যক্রমে বসতে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটি বিচার বিভাগের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পথে বড় বাধা। এছাড়া এটি অসাংবিধানিক ও বেআইনি। বর্জনের কারণে অন্যের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘিত হতে পারে।
বর্জনের প্রধান কারণ ও প্রভাব:
সংবিধান লঙ্ঘন:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আইনানুগ পন্থা ব্যতীত কারো সম্পদ, স্বাধীনতা, জীবন ও সুনাম ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।” কোট বর্জন হল বিচারকের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার বেআইনি পন্থা। এটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং বিচারকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে।
বিচার প্রার্থীদের ক্ষতি:
কিছু আইনজীবী আদালত বর্জন করে, যেখানে অধিকাংশ বারের আইনজীবীর সম্মতি থাকে না। অন্য জেলা থেকে বিচার প্রার্থীরা এসে আদালত বন্ধ পেলে তারা হয়রানির শিকার হয়। পাশাপাশি, আইনজীবীদের সহকারীদের আয় বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিচার প্রার্থী, অন্যান্য আইনজীবী এবং সহকারীদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আইনের শাসনের প্রতি হুমকি:
সংবিধানের প্রস্তাবনায় মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, সমতা ও ন্যায়বিচারের কথা উল্লেখ আছে। বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালত বর্জন করলে এটি এই লক্ষ্যকে বিপন্ন করে। আইনের শাসনের মূল নীতি হল, “Be you ever so high, the law is always above you”। বিচারকের দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
বিচার প্রার্থীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন:
সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দ্রুত বিচার পাওয়াটা একজন বিচার প্রার্থীর মৌলিক অধিকার। আদালত বর্জনের মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত হলে এটি সেই অধিকার লঙ্ঘন করে।
আইন অনুযায়ী দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা: বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাকটিশনারস্ এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২-এর “আদালতের প্রতি কর্তব্য” অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বিচারকরা নিজেকে ডিফেন্ড করতে পারলে ও অসার পরিস্থিতিতে হয়রানিতে পড়তে পারেন। তাই আইনজীবীরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহযোগী হতে হবে। কোনো অভিযোগ থাকলে তা আইন অনুযায়ী মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আইন সচিব বা জেলা জজের কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে। কোট বর্জন করা বেআইনি ও অপ্রয়োজনীয়।
আদালত বর্জন কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ?
বিচারকের বিরুদ্ধে গিয়ে আদালত বর্জন করা লিগ্যাল প্রাকটিশনারস্ অর্ডারের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পেশাগত অসদাচরণ। এর ফলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিরুদ্ধে তিরস্কার, সাময়িক বরখাস্ত বা সনদ বাতিলের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দণ্ডবিধি ১৮৬, ১৮৯ ও ২২৮ ধারা অনুযায়ী, বিচারককে সরকারি দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া, হুমকি প্রদান বা বিচার কাজে ইচ্ছাকৃত বাধা দেয়া সবই অপরাধ। তাই কোট বর্জনের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি ও অপরাধমূলক।
একজন আইনজীবীর পেশা ব্যবসা নয়, এটি সেবা। আদালত ও আইনজীবী এক পাখির দুটি ডানা। একটি ডানা ছাড়া অন্যটি কার্যকর নয়। আইনজীবীদের উচিত বিচারকদের কাজে সহযোগিতা করা। বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিনে বলেছেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে কলমে থাকলেও, যদি বিচারক নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন, তবে স্বাধীনতা বাস্তবে হারিয়ে যায়।”