মৃতপ্রায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে পুনরুজ্জীবিত করতে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য ২০০৯ সালের বিদ্যমান মানবাধিকার কমিশন আইন রহিত করে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে নতুন একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত এই আইনে কমিশনকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনা তদন্ত ও অনুসন্ধানের পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হচ্ছে। কমিশন প্রয়োজনে কারাগার, হেফাজত কেন্দ্র কিংবা সংশোধনাগারসহ দেশের যেকোনো স্থানে পরিদর্শন করতে পারবে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠনের পরও প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা আয়নাঘরসহ বিভিন্ন বাহিনীর হাতে গুম, আটক ও নির্যাতনের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো কমিশন তদন্ত বা অনুসন্ধান করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান আইনে কমিশনের এ ধরনের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার নেই। ফলে মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে কমিশন যে ক্ষমতা পাচ্ছে:
প্রস্তাবিত ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ কমিশনকে দেওয়া হচ্ছে বিস্তৃত ক্ষমতা ও কার্যক্রমের সুযোগ। নতুন আইনের ১৩তম ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে অন্য কারো আবেদনের ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা তার প্ররোচনার অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে। জনসেবক কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্ররোচনা বা প্রতিরোধে অবহেলার অভিযোগও কমিশনের অনুসন্ধানের আওতায় আসবে।
একই ধারার ‘গ’ উপধারায় বলা হয়েছে, কমিশন জেলখানা, সংশোধনাগার বা হেফাজত কেন্দ্রসহ আটক স্থানের পরিবেশ পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় উন্নয়নের সুপারিশ দিতে পারবে। পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণেও পদক্ষেপ নিতে পারবে। প্রস্তাবিত আইনে কমিশনকে মানবাধিকার সংরক্ষণে বাধাস্বরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে প্রতিকারমূলক সুপারিশ দেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলের সঙ্গে দেশের আইন ও নীতিমালার সামঞ্জস্য যাচাই, প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রস্তাব এবং নতুন চুক্তি অনুমোদন বা বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ দিতে পারবে কমিশন। মানবাধিকার বিষয়ক গবেষণা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এনজিও ও সুশীল সমাজের কার্যক্রম সমন্বয়, উৎসাহ প্রদান এবং মানবাধিকার রক্ষায় প্রশাসনিক বা আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে থাকবে। প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত বিচারাধীন মামলায় কমিশন চাইলে আদালতে পক্ষ হিসেবেও অংশ নিতে পারবে।
কমিশনে অভিযোগ পেশ ও প্রতিকার:
প্রস্তাবিত ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ১৫ নম্বর ধারায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল ও প্রতিকার পাওয়ার বিস্তারিত প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারায় বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা এর প্ররোচনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে কিংবা তার পক্ষে অন্য কেউ কমিশনে অভিযোগ করতে পারবেন—এতে কোনো ফি লাগবে না। অভিযোগ লিখিত, মৌখিক বা নির্ধারিত অন্য কোনো মাধ্যমে দাখিল করা যাবে। কমিশন প্রতিটি অভিযোগের জন্য রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান করবে। সাধারণত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগ দাখিল করতে হবে, তবে যুক্তিসংগত কারণ থাকলে কমিশন বিলম্ব মওকুফ করতে পারবে।
একই ধারার ৪ ও ৫ নম্বর উপধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কমিশন অভিযোগ পাওয়ার পর বা অন্যভাবে অবগত হলে তদন্ত চালাতে পারবে। তদন্ত কমিশনার, কর্মকর্তা বা বিশেষ তদন্ত দলের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ৩০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। অভিযোগ অমূলক হলে তা নথিজাত হবে, আর সত্যতা পাওয়া গেলে কমিশন তদন্তের আনুষ্ঠানিক আদেশ দেবে।
৭ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদনে লঙ্ঘনের কারণ, প্রমাণ ও প্রতিকার স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রয়োজন মনে করলে কমিশন ৩০ দিনের মধ্যে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবে। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তা নথিজাত হবে; আর প্রমাণিত হলে কমিশন উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানির দিন নির্ধারণ করবে।
ধারার ১০ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, শুনানিতে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে এবং বিষয়টি যদি ফৌজদারি বা অন্য কোনো আদালতের এখতিয়ারে পড়ে, তাহলে কমিশন প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠাবে ও অভিযোগকারীকে সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেবে। তবে অভিযোগ যদি কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে, তাহলে কমিশন ক্ষতিপূরণ বা জরিমানার আদেশ দিতে পারবে। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা বা প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের সুপারিশ করবে, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।
হাসিনার আমলের অকার্যকর কমিশন, নতুন আইনে আসছে স্বাধীনতা ও ক্ষমতার নিশ্চয়তা:
মানবাধিকার কমিশন প্রথম গঠিত হয় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, আর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালের ১৪ জুলাই সংসদে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন পাস করে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার কমিশনে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দিয়ে একে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-এ পরিণত করেছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম, নির্যাতন ও নিখোঁজের অগণিত ঘটনার পরও কমিশন নীরব থেকেছে। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদ ও অন্য সদস্যরা পদত্যাগ করে আত্মগোপনে গেলে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, শেখ হাসিনার সময়কার আইন মানবাধিকার রক্ষার জন্য নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বৈধতা দেওয়ার উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, কমিশন কার্যকর না হওয়ার প্রধান কারণ দুর্বল আইন ও অতিরিক্ত আমলানির্ভরতা। তার মতে, কমিশনের আইন শক্তিশালী করতে হবে, চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “কমিশনকে পরমুখাপেক্ষী নয়, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, তাহলেই এটি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।”
মানবাধিকারকর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, বিগত সরকার কমিশনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। পছন্দের লোকদের চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় তারা মানবাধিকার নয়, বরং রাজনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি যোগ করেন, “১৬ বছর দেশে স্বৈরতন্ত্র চরমভাবে বলবৎ ছিল। কমিশনে যারা ছিলেন, তারা সরকারের আজ্ঞাবহ ও নতজানু ছিলেন। তাই এবার নিয়োগ দিতে হবে নিরপেক্ষ ও সাহসী মানুষদের।”
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল জানান, নতুন ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়নের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আগের ব্যর্থতা কাটিয়ে একটি স্বাধীন ও কার্যকর কমিশন গঠন করা। তিনি বলেন, আগের কমিশনে নিয়োগ পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবার একটি স্বাধীন বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেখানে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। কমিশনার নিয়োগে গণবিজ্ঞপ্তি, সাক্ষাৎকার ও যোগ্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কমিশনার সংখ্যা ৩ থেকে ৭-এ বাড়ানো হয়েছে, যেখানে এক-তৃতীয়াংশ নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
ড. আসিফ নজরুল আরো জানান, আগের আইনে শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু নতুন আইনে সেই সীমাবদ্ধতা তুলে দেওয়া হয়েছে। কমিশন এখন যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারবে। কমিশনকে ক্ষতিপূরণ আদায়, জরুরি আদেশ জারি এবং দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
নতুন আইনে কমিশনের আদেশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে—এর ব্যয়কে রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি ও সরকারি সুবিধা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে দক্ষ জনবল ধরে রাখা যায়।
তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতেই আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। “এবার আর কমিশন অজুহাত দিতে পারবে না যে তার আইনগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা আছে। “আমরা বিশ্বাস করি, নতুন আইন কমিশনকে মানবাধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেবে।