মৃত এনামুল হাসান লিমনের বড় ভাই মোঃ মেহেদী হাসান (লিটন) ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ মোরলগঞ্জ থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, তিনি ও তার মৃত ভাই নব্বইরাশি বাস স্ট্যান্ড এলাকায় একটি দোকান চালাতেন।
দাবি অনুযায়ী, ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ রাত ৯টার দিকে দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী রফিকুল ইসলাম শেখ, মোঃ মোহন খলিফা, ওবায়দুল হাওলাদার এবং অন্যরা তার দোকানে এসে এনামুলকে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে আসার পর তার ভাই বাড়িতে পৌঁছায়নি। পরদিন তিনজনকে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা সন্তোষজনক কোনো তথ্য দেননি। এরপর ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সকাল ১১টার দিকে স্থানীয় ছেলেরা ক্রিকেট খেলছিল। তাদের বল জনৈক আলমগীরের সীমানায় গেলে তারা সেখানে একজনের পা দেখতে পান। পরে তারা দেখেন মৃতদেহ বালুর স্তূপে ঢাকা। চিৎকারে এলাকার লোকজন ঘটনাস্থলে আসে। বালু সরানোর পর তারা মৃতদেহের দুইটি পা দেখে শনাক্ত করেন।
পুলিশও ঘটনাস্থলে পৌঁছে বালু সরিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করে। নিহত ব্যক্তিকে এনামুল হাসান লিমন বলে শনাক্ত করা হয়। মৃতদেহের সঙ্গে থাকা সোনার চেইন, তিনটি আংটি ও মোবাইল সেট পাওয়া যায়নি। উক্ত এজাহারের ভিত্তিতে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ মোরলগঞ্জ থানায় মামলা নং ২২ দায়ের করা হয় এবং তদন্ত শুরু হয় অভিযুক্ত দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের বিরুদ্ধে।
হত্যাকান্ডে চারজনের ফাঁসির আদেশ:
পুলিশ তদন্ত শেষে দণ্ডবিধির ৩৬৪, ৩০২, ২০৭, ৩৭৯, ৩৪ ও ৪১১ ধারার অধীনে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণের জন্য ১৭ জন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আসামী পক্ষও সাক্ষীদের জেরা করে এবং ৩ জন সাক্ষী হাজির করে। বিচারের শেষে বাগেরহাটের বিজ্ঞ বিচারক দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় চার আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তারা প্রত্যেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ পান। এছাড়া প্রত্যেককে ১০,০০০ টাকা জরিমানা দিতে বলা হয়। পরবর্তীতে আদালত মৃত্যুদণ্ড কনফার্ম করার জন্য মামলার রেকর্ড হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করেন। সেই অনুযায়ী মৃত্যু রেফারেন্স নং ৯৩/২০০৮ নিবন্ধিত হয়।
ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডপ্রাপ্তদের আপিল: দোষী সাব্যস্ত ও শাস্তির রায়ের বিরুদ্ধে চারজন দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী বিভিন্ন আপিল দায়ের করেছেন। মোঃ মোহন খলিফা জেল আপিল নং ৮৬৮/২০০৮ এবং ফৌজদারি আপিল নং ৬৩০৩/২০০৮ দায়ের করেন। ওহিদুল হাওলাদার এবং রফিকুল ইসলাম শেখ ফৌজদারি আপিল নং ৬৩১৮/২০০৮ দায়ের করেন। ওহিদুল হাওলাদার জেল আপিল নং ৮৬৭/২০০৮ দায়ের করেন এবং রফিকুল ইসলাম শেখ জেল আপিল নং ৮৬৬/২০০৮ দায়ের করেন। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত, নতুন আপিল দায়ের: মৃত্যু রেফারেন্স নং ৯৩/২০০৮ সহ আপিলগুলি হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি করা হয়। হাইকোর্ট চ্যালেঞ্জকৃত রায় ও আদেশ বিবেচনা করে ট্রায়াল কোর্টের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে এবং সমস্ত আপিল খারিজ করে দেয়। হাইকোর্টের রায় ও আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীরা নতুন করে আপিল দায়ের করেন।
- রফিকুল ইসলাম শেখ ফৌজদারি আপিল নং ১২৩/২০১৪ দায়ের করেন।
- মোঃ মোহন খলিফা ফৌজদারি আপিল নং ১১৮/২০১৪ দায়ের করেন।
- মোঃ মোহন খলিফা এবং ওহিদুল হাওলাদার জেল আপিল নং ১৭এ/২০১৫ দায়ের করেন।
রফিকুল ইসলাম শেখের পক্ষে আপিলকারীর দাবি:
জনাব মনসুর হাবিব এবং জনাব শামসুল হক রফিকুল ইসলাম শেখের পক্ষে বলেন, ট্রায়াল কোর্ট ও হাইকোর্টের রায়ে গুরুতর ভুল হয়েছে। তাদের দাবি, রফিকুল যে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দিয়েছেন তা সত্য ও স্বেচ্ছায় নয়। তিনি বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এটি দিয়েছেন।
আপিলকারীর যুক্তি, ভুক্তভোগী শেষবার ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ রাত ৯টায় অভিযুক্তদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এরপর তিনি ১০ দিন নিখোঁজ ছিলেন। অবশেষে তার মৃতদেহ সারেলিয়ার আলমগীরের নির্মাণাধীন ভবনের বালুর স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়। তাই রফিকুল ইসলাম শেখের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র নেই। এছাড়া শেষবারের দেখা যাওয়ার তথ্য এই মামলায় প্রযোজ্য নয়।
রফিকুল ইসলাম শেখের আপিল: ময়নাতদন্ত এবং সাক্ষ্য নিয়ে বিতর্ক:
আপিলকারীর দাবি, দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীরা স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলেছেন যে তারা গামছা দিয়ে ভুক্তভোগীর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। কিন্তু মৃতের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, ঘাড়ের তৃতীয় কশেরুকায় শ্বাস নেওয়ার নলে কাটা বা ছিদ্রের চিহ্ন রয়েছে। এই চিহ্ন সাধারণত ধারালো বস্তু দ্বারা হয়। আপিলকারীর যুক্তি, এটি হত্যা প্রক্রিয়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র লক্ষণ।
তাঁরা আরও বলেন, সাক্ষীরা আগ্রহী ব্যক্তি এবং দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর প্রতি শত্রুতা পোষণকারী। তাই তাদের সাক্ষ্যকে দোষ প্রমাণে বিবেচনা করা উচিত নয়। এছাড়া, এফআইআর দায়ের করতে ১০ দিনের অযৌক্তিক বিলম্ব হয়েছে। এফআইআরের কলাম-৪ ও ৫ এবং এফআইআরের নীচে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
মোঃ মোহন খলিফা ও ওহিদুল হাওলাদারের আপিল: স্বীকারোক্তি ও ময়নাতদন্ত নিয়ে বিতর্ক:
জনাব জিয়াউর রহমান, বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট, দণ্ডপ্রাপ্ত মোঃ মোহন খলিফা ও ওহিদুল হাওলাদারের পক্ষে বলেন, হাইকোর্ট স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতির উপর নির্ভর করে ট্রায়াল কোর্টের রায় বহাল রেখেছে। তাদের দাবি, উক্ত জবানবন্দি স্বেচ্ছামূলক ছিল না। এটি বাধ্যতামূলকভাবে, বিধি-নিয়ম না মেনে রেকর্ড করা হয়েছিল। সব বিবৃতিই প্রায় একই রকম ছিল, যা অযৌক্তিক এবং অবিশ্বাস্য।
আপিলকারীর যুক্তি, হাইকোর্ট বিবেচনা করেননি যে পিডব্লিউ-৩ শাহিদা বেগম ও পিডব্লিউ-৮ মোঃ তাজুল ইসলাম স্বীকার করেছেন যে তাদের ছেলে নিখোঁজ থাকার সময় তারা মোরলগঞ্জ থানায় একটি জিডি দায়ের করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ ডায়েরি ও প্রাথমিক তথ্য প্রতিবেদনের তথ্য পরস্পরবিরোধী ছিল। সাধারণ ডায়েরিতে দণ্ডপ্রাপ্তদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এজন্য চ্যালেঞ্জকৃত রায় ও আদেশ বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং দোষী সাব্যস্তকারী আপিলকারীর বিবৃতি একে অপরের সাথে মেলে না। এতে দণ্ডপ্রাপ্তদের দেওয়া স্বীকারোক্তির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। এই কারণে চ্যালেঞ্জকৃত রায় ও আদেশ বাতিল করা যায়।
রাষ্ট্রপক্ষের দাবি: ট্রায়াল ও হাইকোর্টের রায় সঠিক:
জনাব বশির আহমেদ, বিজ্ঞ ডেপুটি অ্যাটর্নি-জেনারেল, রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত হয়ে বলেন, ট্রায়াল কোর্ট ও হাইকোর্ট রেকর্ডের প্রমাণ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতির ভিত্তিতে মোহন খলিফা, রফিকুল ইসলাম শেখ ও ওহিদুল হাওলাদারের দোষ প্রমাণ হয়েছে। পিডব্লিউ-১০ ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্যও বিবেচনা করা হয়েছে। হাইকোর্ট বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, উক্ত স্বীকারোক্তি সত্য ও স্বেচ্ছামূলক। পিডব্লিউ-১০ সকল বাধ্যতামূলক বিধি মেনে রেকর্ড করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি, এইভাবে ট্রায়াল কোর্ট ও হাইকোর্ট কোনো ভুল বা অবৈধতা করেনি। এছাড়া, সাক্ষ্য আইনের ৩০ ধারার বিধান অনুযায়ী, যৌথ বিচারে অন্যান্য সহায়ক প্রমাণের আলোকে অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি ব্যবহার করার কোন বাধা নেই।
আদালতের পর্যবেক্ষণ: মৃত্যুর কারণ ও প্রমাণ বিশ্লেষণ:
আদালত সংশ্লিষ্ট পক্ষের উপস্থাপিত বিষয়গুলো বিবেচনা করেছেন। ট্রায়াল কোর্ট ও হাইকোর্টের রায়, অভিযোগকারী ও প্রতিরক্ষা পক্ষের প্রমাণ, এবং দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের দেওয়া বিবৃতিও পর্যালোচনা করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ, হামলাকারীরা ভুক্তভোগী এনামুল হাসান লিমনকে হত্যা করেছেন। ময়নাতদন্তে নিম্নলিখিত আঘাত উল্লেখ করা হয়েছে:
- ঘাড়ের পিছনের অংশে সামান্য আঘাত।
- মাথার ত্বক পচে গেছে।
- ঘাড়ের তৃতীয় কশেরুকায় শ্বাসনালী কাটা চিহ্ন রয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, মৃতদেহে দেখা এই আঘাতের ফলে রক্তক্ষরণ ও শকের কারণে মৃত্যু হয়েছে। এই আঘাত ছিল হত্যার প্রকৃতির এবং মৃত্যুর পূর্ববর্তী অবস্থায় ঘটেছে।
দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মোহন খলিফা:
এই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী মোহন খলিফা, রফিকুল ইসলাম শেখ ও ওহিদুল হাওলাদার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মোহন খলিফার জবানবন্দি অনুযায়ী, তিনি ভ্যান চালক। তার বন্ধুদের মধ্যে রফিকুল, অহিদুল এবং মৃত লিমনও ছিলেন। তারা মাঝে মাঝে একসাথে গাঁজা খেতেন।
জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, ঘটনার ৮-১০ দিন আগে তারা লিমনকে হত্যা করে তার চেইন ও আংটি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। রফিকুল এই প্রস্তাব দেয়, তবে অহিদুল আপত্তি জানান। ঘটনার দিন মোহন খলিফা দিনের বেলা রডের দোকান থেকে লোহার রড নামাতেন। পরে রফিকুল লিমনকে ডেকে পাঠায়।
জবানবন্দি অনুযায়ী, ঘটনার সময়ে রফিকুল গামছা দিয়ে লিমনের গলায় প্যাঁচ দিয়ে ধরে। লিমন প্রতিরোধের চেষ্টা করলে মোহন খলিফা এবং অহিদুল তার পা ও হাত চেপে ধরেন। এর ফলে লিমন মারা যায়। পরে তারা লিমনের চেইন, আংটি, ঘড়ি ও মোবাইল নিয়ে যায় এবং দেহ বালুর স্তূপে চাপা দেয়। মোহন খলিফা বলেন, পরদিন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি: রফিকুল ইসলাম শেখ:
রফিকুল ইসলাম শেখের জবানবন্দি অনুযায়ী, তিনি গরীব এবং কষ্টে সংসার চালান। শীতকালে ইট ভাটায় ইট কাটি, অন্য সময় ভ্যান চালান। ভ্যান চালিয়ে মাত্র ৩০-৪০ টাকা উপার্জন হয়, যা সংসার চালাতে যথেষ্ট নয়। তিনি রিক্সা কিস্তি শোধের জন্য অর্থের অভাবে লোভের কারণে এই অপরাধ করেছেন।
জবানবন্দি অনুযায়ী, নিহত লিমন তার বন্ধু ছিলেন। লিমনের কাছে চেইন, আংটি ও মোবাইল ছিল, যা দখলের জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ঘটনার ১০ দিন আগে মোহন খলিফা ও অহিদুলের সঙ্গে তারা গাঁজা খেতে বসে লিমনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। ঘটনার দিন বিকাল ৫টার দিকে রফিকুল জিউধারা থেকে মরেলগঞ্জ শহরে আসেন। রাত ৮টার পর তিনি মোহন ও অহিদুলের সঙ্গে লিমনকে ডেকে নিয়ে যান গাঁজা খাওয়ার জন্য। তারা উত্তর সরালিয়ার একটি নির্মীয়মান বাড়িতে গিয়ে সিঁড়ির উপরে বসেন।
রফিকুল বলেন, তিনি গামছা দিয়ে লিমনের গলায় প্যাঁচ দিয়ে ধরে। লিমন প্রতিরোধ করলে মোহন পা চেপে ধরে, অহিদ মুখ ও হাত চেপে ধরে। এর ফলে লিমন মারা যায়। এরপর তারা লিমনের চেইন, আংটি ও মোবাইল নিয়ে যায়। মরদেহ বালুর স্তূপে লুকিয়ে রাখা হয়। রফিকুল বলেন, তিনি মালগুলো মায়ের কাছে দেন এবং ঘটনার কথা খুলে বলেন। ঘটনার দুই দিন পরে তিনি জিউধারায় ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি: অহিদুল হাওলাদার:
অহিদুল হাওলাদারের জবানবন্দি অনুযায়ী, তিনি রিক্সা চালান। নিহত লিমন, রফিকুল ইসলাম শেখ ও মোহন খলিফা তার বন্ধু। তারা একসাথে গাঁজা খেতেন। জবানবন্দিতে উল্লেখ, ঘটনার ৮-১০ দিন আগে তারা হামিদ মাস্টারের বাসার পাশে বসে লিমনকে হত্যা করে তার চেইন ও আংটি নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। অহিদুল তখন তীব্র আপত্তি জানান, কারণ এতে এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হবে এবং লিমনের আত্মীয়-স্বজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঘটনার দিন, রফিকুল মোহনের কাছ থেকে গামছা নিয়ে লিমনের গলায় প্যাঁচ দিয়ে ধরে। লিমন প্রতিরোধ করলে অহিদুল তার হাত চেপে ধরে, মোহন পা চেপে ধরে এবং শরীরের ওপর চাপ দিয়ে বসে। এর ফলে লিমন মারা যায়। এরপর অহিদুল লিমনের চেইন ও আংটি খোলে। মোহন বালিতে গর্ত খুঁড়ে দেহ চাপা দেয়। অহিদুল বলেন, পরে তিনি লিমনের ভাই লিটনের সঙ্গে লিমনকে খুঁজতে বের হন। হত্যার ঘটনা কাউকে বলতে পারেননি। দীর্ঘদিন কষ্টে ভুগেছেন। পরবর্তীতে পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে।
সাক্ষ্য পর্যালোচনা: ম্যাজিস্ট্রেটের রেকর্ড এবং দোষ স্বীকার:
পিডব্লিউ-১০ শ্রী সরোজ কুমার নাথ, তৎকালীন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি বাগেরহাটে কর্মরত ছিলেন, দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় রফিকুল ইসলাম শেখ, মোহন খলিফা ও ওহিদুল হাওলাদারের পাশাপাশি অভিযুক্ত জোরিনা বেগমের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেছেন।
তিনি সাক্ষ্য দিয়ে জানান, প্রদর্শনী ০৪, ০৪এ, ০৪বি, ০৪সি এবং তাদের স্বাক্ষরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নথি যাচাই করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, তিনি আইনের বাধ্যতামূলক বিধি মেনে বিবৃতিগুলি রেকর্ড করেছেন। বিবৃতিগুলোর সত্যতা এবং স্বেচ্ছামূলক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন। দণ্ডবিধির ৩৪২ ধারায় দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যে তারা উক্ত অপরাধে যুক্ত। কিন্তু তারা স্বীকারোক্তি সম্পর্কিত কোনো বক্তব্য দেননি।
আদালতের মতামত ও আসামী পক্ষের দাবি খারিজ:
আদালত রফিকুল ইসলাম শেখের মা ও অভিযুক্ত জরিনা বেগমের স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি পরীক্ষা করেছেন। আদালতের মত, দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার সময় পিডব্লিউ-১০ আইনের প্রাসঙ্গিক বিধি মেনে চলেছেন। তাই বলা যায় না যে, উক্ত বিবৃতিগুলি সত্য এবং স্বেচ্ছামূলক নয়।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, দোষী সাব্যস্তকারীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে যদি তা সত্য ও স্বেচ্ছায় প্রাপ্ত হয়, যদিও পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়। আসামী পক্ষ পিডব্লিউদের প্রমাণ দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মামলার একজন অভিযুক্ত জরিনা বেগম তার স্বীকারোক্তিতে (দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায়, প্রদর্শনী ৪) জানিয়েছেন, ২ তারিখে আমার ছেলে রফিকুল সকাল ৮-৯ টার দিকে আমার কাছে একটি ঘড়ি, চেইন, তিনটি আংটি ও মোবাইল প্যাকেটে এনে দেয়। আমি জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, সে নিজে ও অহিদুল ও মোহন মিলে লিমনকে মেরেছে। পরে সে নতুন বাড়ির জন্য আনা বালির মধ্যে লাশ লুকিয়েছে। আমি মালগুলো ঘরে আনিনি, বাহিরে বাথরুমের পাশে গর্তে রাখি। পর রাতে পুলিশ গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি মাল বের করি।” রফিকুল ইসলাম শেখের মা জরিনার এই বিবৃতিকে জব্দ তালিকা ও প্রদর্শনী ৯ সমর্থন করে। প্রদর্শনী ৪ এবং প্রদর্শনী ৯ মিলিয়ে রফিকুলের স্বীকারোক্তি (প্রদর্শনী ৪এ) সমর্থিত হয়েছে।
সাক্ষ্য ও আপিল পর্যালোচনা, বিলম্বিত এফআইআর ও স্বীকারোক্তি নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ:
আপিলকারীদের আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি দেন যে, মামলাটির এফআইআর দেরিতে দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু আদালত পর্যবেক্ষণে দেখেছেন—ভুক্তভোগী লিমনের মরদেহ উদ্ধারের পরই মামলা দায়ের করা হয়, এবং এফআইআরে বিলম্বের কারণও স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। বিচারের সময় এ নিয়ে কোনো প্রশ্নও তোলা হয়নি। ফলে আদালতের মতে, মামলার প্রেক্ষাপটে এই বিলম্ব অভিযোগপক্ষের অবস্থান দুর্বল করেনি।
বিচারের সময় আসামিপক্ষ তিনজন সাক্ষী হাজির করেন। তাদের দাবি ছিল, পুলিশ দণ্ডপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের মাধ্যমে ১৬৪ ধারার অধীনে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী সরোজ কুমার নাথের সাক্ষ্য অনুযায়ী, স্বীকারোক্তি নেওয়ার সময় দণ্ডিতদের শরীরে কোনো নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, এবং তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও এমন অভিযোগ করেননি। আদালত তাই মনে করেন—আসামিপক্ষের সাক্ষীরা বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অভিযুক্তদের আরেকটি যুক্তি ছিল—অভিযোগকারী পক্ষ নিহত লিমনের হত্যার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রমাণ করতে পারেনি। তবে আদালত স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি এবং সাক্ষীদের বক্তব্য একত্রে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, লিমনকে গামছা দিয়ে গলা শক্ত করে চেপে হত্যা করা হয়।
প্রদর্শনী ৫ নম্বর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, নিহতের গলা ও শ্বাসনালী কাটা ছিল, তৃতীয় সার্ভিকাল কর্টিব্রার ওপরে গভীর ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে চিকিৎসকের মতামত অনুযায়ী—গুরুতর আঘাতজনিত রক্তক্ষরণ ও শোকজনিত কারণে মৃত্যুটি হয়েছে, যা খুনের উদ্দেশ্যেই ঘটানো হয়েছিল।
সাক্ষ্য মূল্যায়ন: স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেই টিকে রইল অভিযোগপক্ষের মামলা:
মামলাটিতে ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকলেও, অভিযোগকারীপক্ষ প্রমাণ করেছে যে নিহত লিমনকে আসামিরা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। এই তথ্য প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি দেন—ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে লিমনের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের কথা উল্লেখ থাকায় এটি গলা টিপে হত্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এককভাবে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে চূড়ান্ত প্রমাণ নয়; এটি কেবল সহায়ক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এ মামলায় যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী নেই, তাই অভিযোগপক্ষের মামলা নির্ভর করেছে চারজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর। সাক্ষীরা প্রমাণ করেছেন যে, দণ্ডিতরা নিহতকে ডেকে নিয়ে যায়। ঘটনার ১০ দিন পর নির্মাণাধীন ভবনের সীমানা প্রাচীরের ভেতর বালির স্তুপ থেকে লিমনের আংশিক পচাগলা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। জব্দ তালিকা (প্রদর্শনী ৯) ও সাজাপ্রাপ্ত রফিকুল শেখের মা জোরিনা বেগমের স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি (প্রদর্শনী ৪) একত্রে বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছেন—অভিযোগকারীপক্ষ সন্দেহের বাইরে তাদের মামলা প্রমাণে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়া আদালত সাক্ষ্য আইনের ৪৫ ধারা উদ্ধৃত করে বলেন, বিশেষজ্ঞের মতামত আদালতের কাছে প্রমাণ হিসেবে বিবেচ্য হলেও তা বাধ্যতামূলক নয়। বিশেষজ্ঞকে তার মতামতের পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হয়। কিন্তু যদি আদালতের সামনে অন্য নির্ভরযোগ্য প্রমাণ থাকে যা বিশেষজ্ঞের মতামতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তবে আদালত সেই প্রমাণকেই অগ্রাধিকার দিতে পারেন। (তথ্যসূত্র: প্রফুল্ল কমল ভট্টাচার্য বনাম গৃহ মন্ত্রণালয়, ২৮ ডিএলআর ১২৩)
স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতির গ্রহণযোগ্যতা: আদালতের বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত:
আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন, মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য ও অন্যান্য প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মূলনীতি অনুসরণ করতে হয়। এর প্রথম মাপকাঠি হলো—স্বীকারোক্তি যেন সাক্ষ্য আইনের ২৪ ধারায় বর্ণিত কোনো প্রলোভন, ভয়ভীতি বা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আদায় না হয়। যদি আদালতের কাছে মনে হয় যে এমনভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে, তবে তা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
প্রথম মাপকাঠি পূরণ হলে দ্বিতীয় ধাপে আদালতের দায়িত্ব হয়—স্বীকারোক্তির বিষয়বস্তু সত্য, নির্ভরযোগ্য ও ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত করা। এ ধরনের বিবৃতি যাচাইয়ের জন্য কঠোর নিয়ম না থাকলেও, আদালতকে সতর্কতার সঙ্গে তা অন্যান্য প্রমাণ ও ঘটনার পরিস্থিতির আলোকে তুলনা করে দেখতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পূর্ণ সমর্থন পাওয়া আবশ্যক নয়; বরং স্বীকারোক্তির মূল প্রবণতা ও মামলার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাধারণ সামঞ্জস্য থাকলেই তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। যদি দেখা যায় স্বীকারোক্তি ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক অংশ এবং অন্যান্য প্রমাণ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে চলে, তবে সেটি সত্য ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে ধরা যায়।
তবে এই মামলায় নিহতের মৃত্যুর কারণ নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে কিছু অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। আদালত বলেন, এই অসঙ্গতি অভিযোগ প্রমাণে কোনো সন্দেহ তৈরি করে না, কারণ মামলার আশেপাশের পরিস্থিতি ও অন্য প্রমাণাদি সাজাপ্রাপ্তদের স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাদের অপরাধ প্রমাণ করে। ফলে ময়নাতদন্তের সামান্য পার্থক্য অভিযোগের সত্যতা নস্যাৎ করতে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আপিল বিভাগ জানায়, অভিযোগকারীপক্ষ যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের বাইরে সকল সাজাপ্রাপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। হাইকোর্ট বিভাগ ও বিচারিক আদালত তাদের দণ্ডাজ্ঞায় কোনো বেআইনি কাজ করেনি। ফলে হাইকোর্টের রায় ও আদেশে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই বলে আদালত মনে করেন। তবে অভিযুক্তদের পক্ষে উপস্থিত আইনজীবী মনসুর হাবিব ও জিয়াউর রহমান আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে কনডেম সেলে রয়েছেন এবং তাদের বয়সও বেশি। তাই মানবিক বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরের আবেদন করেন তারা।
আদালত পূর্ববর্তী নজির “নাজরুল ইসলাম (মৃত) বনাম রাষ্ট্র” [৬৬ ডিএলআর (এডি) ১৯৯] মামলার রায় উদ্ধৃত করে বলেন, কনডেম সেলে দীর্ঘদিন অবস্থান করা সব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তনের ভিত্তি না হলেও, যদি সেটি আসামির কোনো দোষ ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হয়, তাহলে তা রায় পরিবর্তনের যৌক্তিক কারণ হতে পারে। আদালত বলেন, এই মামলায় অপরাধ নিষ্ঠুর হলেও অভিযুক্তদের অতীতে কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। তারা দিনমজুর ও ভ্যানচালক ছিলেন। এসব দিক বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তর করাই ন্যায়সঙ্গত হবে। ফলে, সব আপিল খারিজ করা হয়।
মোঃ মোহন খলিফা ও ওহিদুল হাওলাদারের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হলো। প্রত্যেককে ২,০০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাসের কঠোর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। আর রফিকুল ইসলাম শেখের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হলো। তাকে ২৫,০০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক বছরের কঠোর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
তিনজনকেই দণ্ডবিধির ৩৫এ ধারা অনুযায়ী সাজা গণনার সুবিধা ও জেল কোড অনুসারে অন্যান্য মওকুফের সুযোগ দেওয়া হবে। আদালত কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন, সাজাপ্রাপ্তদের কনডেম সেল থেকে স্বাভাবিক সেলে স্থানান্তর করতে। সূত্র: [৭৪ ডিএলআর (এডি) (২০২২) ২৫১]