বাংলাদেশে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও ভিন্নমত দমনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহারকে দায়ী করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার যে মানবাধিকারের ভয়াবহ অবনতির কারণ, তা কেউই অস্বীকার করতে পারে না।
বিগত সময়ে এমন বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইন করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে মানবাধিকারের ধারণা হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছানির্ভর, সর্বজনীন নয়। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যকারিতা হারানো স্বাভাবিক পরিণতি ছিল।
বিশেষ করে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা সীমা ছাড়ায়। এ অবস্থায় কমিশনের পুনর্গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। দেশে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে, অথচ বিদ্যমান আইনে তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্তের সুযোগ ছিল না।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন যে মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে, তাতে সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কারও বিরুদ্ধেই তদন্তের সুযোগ রাখা হয়েছে। নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় অগ্রগতি। আগে কমিশন কেবল সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাতে পারত, কিন্তু এখন খসড়ায় কমিশনকে যুক্তিসংগত আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে সংস্থার কার্যকারিতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কমিশনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোও ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তবে খসড়ার কিছু ধারা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন, কমিশনের ‘সরল বিশ্বাসে করা কাজের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না’—এমন বিধান আগের আইনের মতোই রাখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের বিধান দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে এবং জবাবদিহির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে এর অপব্যবহারের নজিরও অগণিত।
আইন যতই শক্তিশালী হোক, তার ফল নির্ভর করে বাস্তব প্রয়োগের ওপর। মানবাধিকারের ধারণা সর্বজনীন, তাই এর প্রয়োগও হতে হবে পক্ষপাতমুক্ত ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রভাবশালী যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত থাকুক না কেন, কমিশনের উচিত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
গত সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের দপ্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সরকার আমলেও মব সহিংসতা, বিনা বিচারে আটক ও ধর্মীয় স্থানে হামলার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়ে গেছে। এসব নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যত অচল। প্রায় ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন কমিশন গঠন হয়নি, যা দুঃখজনক। কমিশনের আইন সংশোধন যেমন জরুরি, তেমনি সংস্থাটিকে দীর্ঘদিন অকার্যকর রেখে দেওয়া আরও বড় উদ্বেগের বিষয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশের নতুন খসড়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। তবে মানবাধিকার পরিস্থিতির বাস্তব উন্নতি ঘটাতে হলে এখনো অনেক পথ বাকি।