দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রস্তাব ও আইনের খসড়া পাঠানো হয়েছে, যা নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে আইন মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, অচিরেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠাকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির গতি বাড়াবে এবং বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও স্বচ্ছ করবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো নির্দিষ্ট আদালত নেই। সহকারী জজ থেকে জেলা জজ পর্যায়ের আদালত এসব মামলা নিষ্পত্তি করেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণসংক্রান্ত মামলা অর্থ ঋণ আদালতে নিষ্পত্তি হয়। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিগত বিরোধের ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় আন্তর্জাতিক সালিসি বা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিসি কেন্দ্রের ওপর। এছাড়া হাইকোর্টে রয়েছে অ্যাডমিরালটি ও কোম্পানি বেঞ্চ।
তবে জেলা আদালতগুলোতে মামলা জটের কারণে ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন হয় এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এসব কারণেই সরকার বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।
ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক আদালত ইতিমধ্যে কার্যকরভাবে কাজ করছে। ভারতে জেলা পর্যায় থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত রয়েছে বাণিজ্যিক আদালত। শ্রীলঙ্কায়ও হাইকোর্ট পর্যায়ে এমন আদালত চালু আছে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ২৫ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা হলে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট থেকে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোয়াজ্জেম হোছাইন জানান, পৃথক বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা হলে তা বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে “নতুন যুগের সূচনা” করবে। দ্রুত বিচারপ্রাপ্তি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে ও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক আদালতের আওতায় থাকবে ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন, আমদানি-রপ্তানি, বিমান ও নৌপরিবহন, নির্মাণ, ফ্র্যাঞ্চাইজ, প্রযুক্তি, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট, বিমা, যৌথ উদ্যোগসহ আধুনিক বাণিজ্যের প্রায় সব খাত।
এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জেলা জজদের মধ্য থেকে বাণিজ্যিক আদালতের বিচারক নিয়োগ করা হবে। আপিল শুনানি হবে হাইকোর্টের নির্ধারিত বাণিজ্যিক বেঞ্চে। মামলা দায়েরের আগে মধ্যস্থতাকে বাধ্যতামূলক করা হবে এবং সমঝোতা সালিসি রায়ের মতোই কার্যকর হবে। চূড়ান্ত শুনানি ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার বিধান রাখা হয়েছে। আদালতের এখতিয়ার শুরু হবে ৫০ লাখ টাকা থেকে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও গত জানুয়ারিতে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত করার সুপারিশ করেছিল। কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন পক্ষ দ্রুত বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সংস্কারের তাগিদ দেয়। কমিশনের সদস্য তানিম হোসেইন শাওন বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের খসড়া নিয়ে কাজ চলছে, আশা করছি শিগগিরই এটি বাস্তবায়িত হবে।”
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত কিছু মামলা সহকারী জজ ও যুগ্ম জেলা জজ আদালতে নিষ্পত্তি হয়। বিশেষ আদালত হলে জেলা পর্যায়ে মামলা দ্রুত শেষ হবে, ফলে অন্যান্য আদালতের ওপর চাপও কমবে।
আইনজীবী ব্যারিস্টার মোকছেদুল ইসলাম এই উদ্যোগকে “প্রশংসনীয়” বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “বাণিজ্যিক লেনদেনসংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি বিনিয়োগ পরিবেশকে স্বচ্ছ করবে। তবে শুধু নতুন আদালত গঠন করলেই হবে না, সংশ্লিষ্ট পক্ষদেরও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে।”

