শরীয়তপুরে জমি-সংক্রান্ত একটি দেওয়ানি মামলায় সিনিয়র সহকারী জজের রায় মনঃপূত না হওয়ায় জেলা ও দায়রা জজ মো. সোলাইমান রায়ের কপি ছিঁড়ে ফেলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মামলার নথি তলবের সময় জালিয়াতি করা এবং রায় ঘোষণা হয়ে গেলেও পুরোনো তারিখ দিয়ে মামলা বদলির মতো ঘটনা ঘটেছে।
রায়ের কপি ছিঁড়ে ফেলার বিষয়টি জানাজানি হলে সিনিয়র সহকারী জেলা জজ আরিফুল ইসলাম (বর্তমানে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) কে ডেকে জেলা জজ গালাগাল করেন, এসিআর খারাপ দেওয়ার হুমকি দেন এবং পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও করেছেন।
এ ঘটনায় দুই বিচারকের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ কথোপকথনের ৯৪ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের একটি কলরেকর্ডও হাতে এসেছে। রেকর্ডে দেখা যায়, জেলা জজ আরিফুল ইসলামের উপর অকথ্য ভাষায় কথা বলছেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “তুমি ফারদার (ফের) এগোলে, আমি তোমাকে ছাড়ব না। তুমিও স্টপ হয়ে যাও, আমিও স্টপ হয়ে যাব।”
বিচারক আরিফুল ইসলাম এই ঘটনায় প্রধান বিচারপতি, আইন উপদেষ্টা ও আইন সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন, দেওয়ানি ১৬৭/২১ নম্বর মামলার রায়ের মূল কপিটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে এবং নথি অন্য কোর্টে পুনর্বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া দুর্ব্যবহার ও ক্ষতি করার হুমকির বিষয়টিও উল্লেখ করে তিনি আইনগত প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছেন। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৯৩ সালে ভেদরগঞ্জের বাসিন্দা নূরবক্স মারা গেলে তার চার স্ত্রী ৭৮ শতাংশ সম্পত্তি বিক্রি করেন। বিক্রির সময় তাদের সন্তানরা সাত থেকে আট বছরের নাবালক ছিলেন।
২০২১ সালে নূরবক্সের সন্তানরা, বাদী আসলাম মাজিসহ তার ভাইবোনরা, জমির মালিকানা দাবি করে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু সিনিয়র সহকারী জজ আরিফুল ইসলাম (ভেদরগঞ্জ) গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি খারিজ করেন। রায়ে বলা হয়, বিক্রির সময় সন্তানরা নাবালক ছিল এবং বর্তমানে জমিতে তাদের কোনো দখল নেই। তাই তারা জমির মালিকানা দাবি করতে পারবে না। একই সঙ্গে, ওইদিনের কার্যতালিকা ও আদালতের ডায়েরিতে রায়ের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
রায়ের আগে, ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক শেষে ২৪ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা করার দিন ঠিক করা হয়। এটি দৈনিক কার্যতালিকা ও আদালতের ডায়েরিতেও লিপিবদ্ধ আছে। তবে জেলা ও দায়রা জজ মো. সোলাইমান রায়ে সন্তুষ্ট হননি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আগের জেলা জজ অনুপ কুমারের সময়ে নিষ্পত্তিকৃত মামলাটি ফের বিচারে নেওয়ার জন্য কৌশল সাজান।
শরীয়তপুর আদালত সূত্রে জানা গেছে, রায় ঘোষণার দুই দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর কাজ শেষে সিনিয়র সহকারী জজ আরিফুল ইসলাম বাসায় চলে যান। এরপর রাতে জেলা ও দায়রা জজ মো. সোলাইমান ‘অতিবজরুরি’ হিসেবে মামলার নথি তলব করেন। নথি তলবের চিঠিতে জেলা জজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হায়াতুল হক স্বাক্ষরিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘সত্ত্বর প্রেরণের জন্য মাননীয় সিনিয়র জেলা জজ মহোদয় নির্দেশ দিয়েছেন।’ চিঠিতে আগের জেলা জজ অনুপ কুমারের নাম উল্লেখ থাকলেও, তিনি ঘটনার আগে ১৫ সেপ্টেম্বর ওই আদালত থেকে বদলি হয়ে অন্য আদালতে চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়া, চিঠিতে পুরোনো তারিখ দেওয়ার কথা থাকলেও ভুলবশত ২৬ সেপ্টেম্বরের তারিখ লেখা হয়। প্রশাসনিক কর্মকর্তার এই ভুল জেলা জজ সোলাইমানের নজরে আসে।
বিচারক আরিফুল ইসলামের অভিযোগ, নথি তলবের বিষয়টি বাইরে প্রকাশ না করতে জেলা জজ কর্মচারীদের নির্দেশ দেন। এরপর জেলা জজ মো. সোলাইমান মামলার রায়ের কপি ছিঁড়ে ফেলেন। ঘটনার ধামাচাপা দিতে ওইদিন বিকেল ৪টা ৯ মিনিটে আরিফুল ইসলামকে সিনিয়র সহকারী জজ (ভেদরগঞ্জ) থেকে জুনিয়র আদালত সহকারী জজ (গোসাইরহাট) হিসেবে বদলি করা হয়। তবে এই বদলির আদেশ কার্যকর হবে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে।
আদালতে বদলি হওয়ার পর বিচারক আরিফুল জানান, ‘এ মামলায় যেন আমি আর হাত না দিতে পারি’—সেজন্য আমাকে তৎক্ষণাৎ বদলি করা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর নতুন আদালতে রায়ের আলোকে নথির শেষ আদেশ লেখার জন্য নথি চাইলে বেঞ্চ সহকারী জানান, নথি তার কাছে নেই। জেলা ও দায়রা জজের নির্দেশে তা সেরেস্তা শাখায় পাঠানো হয়েছে।
বিচারক আরিফুল ইসলাম অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন, রায় ঘোষণার পর জেলা জজ মো. সোলাইমান নথি জালিয়াতির মাধ্যমে বদলের চেষ্টা করেন। এই ঘটনা বিভিন্ন বিচারক, আদালতের কর্মচারী ও আইনজীবীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার ধামাচাপা দিতে জেলা জজ একই দিনে একটি মিস কেস (৮৯/২৪ নং) তৈরি করে মামলা বদলির আদেশ দেন। এটি রেজিস্ট্রার খাতায় ভিন্ন কালিতে লেখা আছে। বর্তমানে মামলাটি সহকারী জজ (নড়িয়া) সাদ্দাম হোসেনের আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
আরিফুল ইসলাম বলেন, ২৯ সেপ্টেম্বর জেলা জজ তাকে খাস কামরায় ডেকে নিয়ে রায় না লেখার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “তুমি মামলার রায় আর লিখতে পারবে না, কাউকে বলতেও পারবে না।” এ সময় আরিফুল তাকে জানান, “রায় ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। ডায়েরি ও কজলিস্টে উল্লেখ আছে।” এই কথা শুনে জেলা জজ রাগান্বিত হয়ে চিৎকার শুরু করেন এবং খাস কামড়া থেকে বের করে দেন। তিনি চিৎকার করে বলেন, “বেডা তোরে বলতেছি, রায় দিতে পারবি না।” এ ঘটনা বিভিন্ন বিচারকের সঙ্গে শেয়ার করার পর থেকে আরিফুলের সঙ্গে জেলা জজের আচরণ খারাপ হতে শুরু করে।
আরিফুল আরও উল্লেখ করেন, “জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে উনার অত্যাচার ও খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে ও নিজেকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ২০২৫ সালের পর বিভিন্ন সময়ে মোট ১১৯ দিনের অর্জিত ছুটি নিয়েছি। পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের ৯ জুলাই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি হয়ে আসি।”
১৫ অক্টোবর সকালে জেলা জজ আরিফুলকে অফিসে ডেকে তার এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) ও কাটানো ছুটির প্রমাণাদি আনতে বলেন। ওইদিন দুপুরে আদালতে দেখা হলে দুজনের মধ্যে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে দীর্ঘ কথোপকথন হয়। কলরেকর্ডে আরিফুল বলেন, তিনি রায় দিয়েছে এবং তা ডায়েরি ও কজলিস্টে লিপিবদ্ধ আছে। জেলা জজ বারবার দাবি করেন, নথিতে কোনো রায় পাওয়া যায়নি এবং তিনি নথি তলব করছেন। কললগ থেকে উদ্ধৃত কিছু মূল বক্তব্য নিম্নরূপ:
- আরিফুল: “আমি কি অপরাধ করেছি স্যার।
- সোলাইমান: “নথি নেওয়ার ক্ষমতা ২৪ ধারায় জেলা জজকে দেওয়া আছে।”
- আরিফুল: “পেশকার সাহেব বলছে আপনি রায় ছিঁড়ে ফেলছেন। রায় দিয়ে আমি রিসিভ করাইছি।”
- সোলাইমান (বারবার): “আমি নথিতে কোনো রায় পাই নাই।”
কলরেকর্ডে জেলা জজ আরিফকে এসিআর খারাপ দেওয়ার হুমকি দেন। এছাড়া পুলিশি ব্যবস্থার আভাস দিয়ে জেলে পাঠানোর কথাও বলেন। আরিফুল প্রতিক্রিয়ায় বলেন তার ইজ্জত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তা তিনি আল্লাহর কাছে যাচাইয়ের জন্য দিয়েছেন।
কলরেকর্ডে জেলা জজের তীব্র ও অপমানজনক ভাষাও ধরা পড়ে। তিনি আরিফকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করে বলেন, “তুই অফিসার হওয়ার যোগ্য না… তুই একটা দুষ্ট ও খারাপ মানুষ… আমি এসিআরে সব লিখব।” এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে নালিশ ও ‘ব্ল্যাক মেইল’ করার অভিযোগ তুলে অপসূত্রধর্মী ভাষাও ব্যবহার করেন। কলরেকর্ডে জেলা জজ প্রতিবাদকারীর জন্য ধর্মীয় ও ব্যাক্তিগত ভিত্তিক কলঙ্কজনক রেফারেন্সও দেন। এই কলরেকর্ডে আদালত ভিতরের একটি তীব্র বৈপরীত্য ও হুমকির চিত্র ফুটে উঠেছে। ঘটনাটি আদালত সংগঠনের ভাবমূর্তি ও বিচারিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো।
একপর্যায়ে জেলা জজ আরিফুলকে বলেন, “এই যে আবেদন করেছে (আইনজীবী) ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে, এ-ও সাহেব প্রভাবিত হইয়া আমার সামনে ২৬ সেপ্টেম্বর উপস্থাপন করছে। যে তারিখে আমার সামনে উপস্থাপন করছে, আমি সেই দিনেই অর্ডার (বদলি) দিয়েছি।” রেকর্ডের ৩০ মিনিটের কথোপকথনে জেলা জজ এসিআর খারাপ দেওয়ার হুমকি দিয়ে বলেন, “আমি তোমার কোনো এসিআর দিতে চাচ্ছি না। দিলে আমি খারাপ দিব। আমি যা জানি তাই লিখব। যদি তুমি স্টপ হয়ে যাও, আমিও স্টপ। তুমি ফারদার এগোলে আমি ছাড়ব না।”
আরিফুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রকাশ্য আদালতে মামলার রায় দিয়েছেন। রায় জেলা জজের মনঃপূত না হওয়ায় রাতের অবৈধভাবে তলব করা হয়েছে এবং সেটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নথি তলব করতে বিচারকের উপস্থিতিতে সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক, যা করা হয়নি। নথি তলবের ঘটনায় আগের জেলা জজ অনুপ স্যারের নাম ব্যবহার হলেও তারিখ ভুলে ধরা পড়েছে। এ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে আরিফুলকে জুনিয়র কোর্টে বদলি করা হয়।
রায়ের সময় সহকারী জজ আদালতের পেশকার মো. শহীদ মৃধা জানান, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট কোর্ট একই এজলাসে বিচার চলত। ২৪ সেপ্টেম্বর দেওয়ানি ১৬৭/২১ মামলার রায় ওপেন কোর্টে ঘোষণা করা হয়। দুই দিন পর জেলা জজ নথি তলব করেন এবং পরে আরিফুলকে বদলি করা হয়। রায়ের পর ২৪ ধারা ব্যবহার করে নথি তলব বা মামলা বদলির সুযোগ নেই।
জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু বলেন, “২৪ ধারা মামলা বদলির জন্য। রায়ের পর এই ধারা ব্যবহার বা মামলা বদলির সুযোগ আইনত নেই। রায় ছিঁড়ে ফেলা গুরুতর অভিযোগ। এমন ঘটনা অবিশ্বাস্য। তদন্ত করলে বোঝা যাবে।” অভিযোগের বিষয়ে জানতে শরীয়তপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. সোলাইমানের সঙ্গে একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী জানান, “অভিযোগপত্রের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে রায় ছিঁড়ে ফেলা একটি গুরুতর অভিযোগ। বিষয়টি দেখা হবে। অনুসন্ধান করে যদি সত্যতা পাওয়া যায়, ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রায়ের পর মামলা বদলির সুযোগ নেই। গালি দেওয়ার বিষয়ও নর্মস অনুসারে গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযোগ সত্য হলে আমরা বিষয়টি দেখব।”

