অর্থঋণ আদালত এখন থেকে খেলাপিদের বিদেশে পাচার করা অর্থ ও সম্পদের খোঁজ করতে পারবে। ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ’ সংশোধনের মাধ্যমে এ ক্ষমতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আদালত ঋণের অর্থ অপব্যবহার করে দেশে বা বিদেশে সম্পদ অর্জনের তদন্ত করতে পারবে। বিদেশে অর্থ পাচার বা সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেলে তা ফেরত আনা ও পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থাও নিতে পারবে আদালত।
সরকারের লক্ষ্য, এ উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে ঋণ শৃঙ্খলা ফেরানো ও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক খসড়াটি চূড়ান্ত করে অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে। কোনো আপত্তি না থাকলে এটি অধ্যাদেশ আকারে শিগগিরই জারি হবে।
খসড়ায় দেখা গেছে, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার স্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। অর্থঋণ আদালত প্রয়োজনে খেলাপির জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার ও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থাকার সুযোগ স্থগিত করতে পারবে।
গভর্নরের চিঠি ও প্রত্যাশা: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে অধ্যাদেশটির তিনটি প্রত্যাশিত ফল উল্লেখ করেছেন—
১. খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের সময়সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
২. প্রয়োগ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হবে।
৩. আর্থিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার দক্ষতা ও সুশাসন বাড়বে। তিনি বলেন, এই পরিবর্তন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঋণ শৃঙ্খলা ফেরাবে এবং শ্রেণীকৃত ঋণ কমাতে ভূমিকা রাখবে।
৯০ দিনে মামলার নিষ্পত্তি:
‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের মামলা ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে ৩০ দিন বাড়ানো যাবে। নির্ধারিত সময়সীমা ভঙ্গ হলে আপিলের সুযোগ থাকবে। এছাড়া একতরফা ডিক্রি বাতিলের আবেদনে জামানত জমার হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। কার্যকরী প্রক্রিয়ায় ‘রিকভারি সার্টিফিকেট’ ব্যবস্থা চালু হবে, যা পরিচালনা করবেন রিকভারি অফিসার।
নতুন বিধান: নতুন অধ্যাদেশে একাধিক কার্যকর মামলা দায়েরের প্রথা বাতিল করা হচ্ছে। কার্যকর প্রক্রিয়া ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে, প্রয়োজনে আরও ৬০ দিন বাড়ানো যাবে। জামানতদার ঋণদাতারা অগ্রাধিকার পাবেন। আদালত মামলা দায়েরের আগে নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ, তথ্য প্রকাশ বা দেওয়ানি আটকাদেশ দিতে পারবে। সর্বোচ্চ আটকাদেশের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করা হচ্ছে। অভিজ্ঞ বা প্রশিক্ষিত বিচারকদের একটি পুল থেকে অর্থঋণ আদালতের বিচারক নিয়োগ হবে। পাশাপাশি একটি আপিল আদালতও গঠনের প্রস্তাব রয়েছে।
২০১৯ সালে সরকার ‘অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রস্তাবে খেলাপিদের তথ্য নিয়মিত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ ও পৃথক আদালত গঠনের কথা ছিল। তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ৫৯৩টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে তিন হাজার ২৬৯টি মামলা। উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত আছে আরও ৪২টি মামলা। শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতেই বিচারাধীন মামলা ৮৫৭৮টি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আদালতের রায় পাওয়ার পর খেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে মামলাগুলো দীর্ঘায়িত করছেন। অথচ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, অর্থঋণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেই। উদ্দেশ্য একটাই—মামলা ঝুলিয়ে রাখা।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শীর্ষ খেলাপিদের বেশিরভাগ মামলায় একাধিক রিট রয়েছে। কোনো কোনো মামলায় আটটি পর্যন্ত রিট দায়ের করা হয়েছে। ফলে মামলার নিষ্পত্তি বছরের পর বছর বিলম্বিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার আদালতকে আরও শক্তিশালী করার পথে এগোচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আদালতকে অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়ার চেয়ে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে ট্রাইব্যুনালে বিচার করা গেলে ফল আরও কার্যকর হবে। ট্রাইব্যুনালে গেলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকে না, ফলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।
২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে তা দাঁড়ায় দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৫ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়—যা রেকর্ড বৃদ্ধি। সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের খেলাপি ঋণ ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

