দেশের উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে মামলা পাহাড় ক্রমশ বাড়ছে। দীর্ঘসূত্রতা, বিচারক সংকট এবং নতুন মামলার ধারা বিচারপ্রার্থীদের কষ্ট বাড়াচ্ছে। তবে আশার খবর হলো, সালিশ বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে মামলা দ্রুত মীমাংসার হার ক্রমবর্ধমান। এতে বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত স্বস্তি পাচ্ছেন এবং আদালতের ওপর চাপও কিছুটা কমছে।
দেওয়ানি বিরোধ, দেনাপাওনা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ভাড়া-বাড়ি সমস্যা বা ব্যবসায়িক চুক্তি ভঙ্গ—এসব ক্ষেত্রে সালিশের মাধ্যমে সহজে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। আদালতের তত্ত্বাবধানে বিচারকরা পক্ষগুলোকে আলোচনায় বসান। অনেক সময় রায় না দিয়েই মামলা মীমাংসা হয়ে যায়। এতে সময় ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় হয়।
দেশের উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে মামলা পাহাড়ের মতো জমে আছে। এই অবস্থা একদিনে বা এক বছরে হয়নি। বহু বছরের সমস্যা আজকের অসহনীয় পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। শহর সম্প্রসারণ, সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণ, জমির মূল্য বৃদ্ধি, ভারত ও অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকায় মানুষের আগমন—এসব কারণে বাসস্থানের অভাব বেড়েছে। সামান্য জমি যার আগে কোনো গুরুত্ব ছিল না, তার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিলেটের সুহাসিনী দাশ বনাম জেলা প্রশাসক মামলাও এর প্রমাণ। এই মামলা ৩৩ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। স্বত্ব ঘোষণার মামলায় ৩২ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। মামলাটি ৫৫/১৯৯৩ সালে নিম্ন আদালতে দায়ের করা হয়েছিল। পরবর্তী ধাপ পেরিয়ে এটি হাইকোর্টে আসে। বর্তমানে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন নম্বর ২০২৪/১৯৯৯ হিসেবে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ায় আবেদ আলী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, “মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় জীবনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।” শুধু আবেদ আলী নয়, দেশের উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে প্রায় ৪৬ লাখ ৫২ হাজার ২৬০টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। বিচারক সংকট, আইনি জটিলতা এবং বারবার তারিখ পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘসূত্রতা কমছে না। এর ফলে অনেকে জীবদ্দশায় বিচার না পেয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সেই বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
আইনজীবীদের অভিমত, মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো পদ্ধতিগত জটিলতা। সনাতনী পদ্ধতির কারণে মামলাজট বেড়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নোটিস বছরের পর বছর বিলম্বে জারি হয়। কখনো যথাযথভাবে জারি না হওয়ায় পুনরায় নোটিস দিতে হয়। নোটিস সংশ্লিষ্ট সেকশনে পড়ে থেকে ফেরত আসলে ভুল নথিতে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে, আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে হারিয়ে যায়। এরফলে সাধারণ মানুষ শুধু আর্থিক ক্ষতিই না, মানসিক কষ্টও বহন করছেন। দীর্ঘসূত্র মামলাজট দেশের বিচারব্যবস্থার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
দেশের আদালত ব্যবস্থায় মামলাজট এখন এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটে রূপ নিয়েছে। মামলার শুনানির প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও তা তালিকাভুক্ত করতে দীর্ঘ সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রেই মামলাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদালতের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও তা করা হয় না। আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হলে মামলাগুলো পুনরায় সেকশনে চলে যায়। এরপর নতুন করে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুনানি পর্যন্ত পৌঁছাতে লেগে যায় আরও দীর্ঘ সময়। ফলে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, আর সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর ধরে বিচার না পেয়ে অপেক্ষায় থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে শুধু আইনজীবীদের দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়; প্রশাসনিক জটিলতাও বড় ভূমিকা রাখে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ. এম. মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “সারাদেশের আদালতে মামলাজট একটি বড় সমস্যা। বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার চাইতে আদালতে আসেন, তাই তাদের সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি। বার (আইনজীবী) ও বেঞ্চ (বিচারক) একসঙ্গে কাজ না করলে এই জট কাটানো সম্ভব নয়।” তিনি আরও বলেন, “বর্তমান প্রধান বিচারপতি মামলাজট নিরসনে একটি রোডম্যাপ দিয়েছেন। এটি গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে এই জট দিন দিন আরও বাড়বে।”
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে মামলাজট ক্রমেই গভীর হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যা কাঠামোগত সংস্কারের দায়িত্ব পেয়েছে। অতীতেও এ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। লঘু অপরাধ বা অর্থদণ্ড-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির আওতায় আনা গেলে বিপুলসংখ্যক বিচারাধীন মামলা কমবে।” তিনি আরও মত দেন, “মামলাজট নিরসনে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মতামত গ্রহণও জরুরি।”
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, “প্রধান বিচারপতির নেওয়া পদক্ষেপ ইতিবাচক। কয়েকটি বেঞ্চকে মামলাজট নিরসনের লক্ষ্যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল আনবে।” বিশেষজ্ঞদের মতে, মামলাজট নিরসনে কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি আদালত প্রশাসনের আধুনিকায়ন, নোটিস জারি প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি সংযোজন এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি।
বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এখন দেশের অন্যতম বড় সংকট। প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন ২০০০ সালের আগের পুরোনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে। এতে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জজকোর্টে জমে থাকা লাখ লাখ মামলার কী হবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। বিচার সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আগে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। কমিশনের প্রস্তাব— অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হোক। তাদের যুক্তি, কলকাতা হাইকোর্টে বর্তমানে ৬২ জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি গ্রহণ করা গেলে ছয় মাসেই তিন থেকে চার লাখ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। কমিশনের একজন সদস্য বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় থেকে জরুরি ভিত্তিতে এই নিয়োগ দেওয়া হলে জজকোর্টে মামলার জট দ্রুতই কমবে।’
মামলাজটের মূল কারণ:
বিশেষজ্ঞদের মতে, মামলার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ছোটখাটো বিরোধ বা ব্যক্তিগত সমস্যাও মামলা আকারে আদালতে আসছে। এর ফলে মামলার চাপ বাড়ছে, কিন্তু বিচারকসংখ্যা সে তুলনায় অপর্যাপ্ত থাকায় নিষ্পত্তি ধীরগতির। সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত আপিল বিভাগে জমে থাকা মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ২টি, যা গত বছরের তুলনায় ৮ হাজার বেশি। এসব মামলার মধ্যে রয়েছে বহুল আলোচিত বিডিআর হত্যা মামলা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার ও বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার আপিল। বছরের পর বছর এসব মামলার শুনানি হয়নি, নিষ্পত্তিও হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসাইন জানান, বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচার বিভাগে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। বিচার বিভাগ সচিবালয় বাস্তবায়নের পথে, জেলা আদালতের জন্য গঠিত মনিটরিং টিম কাজ করছে। তিনি বলেন, “অনেক জেলা আদালতে প্রধান বিচারপতি নিজে গেছেন। আশা করছি মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়বে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, আপিল বিভাগে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মামলা বেশি থাকায় সময় বেশি লাগে। এ কারণে ওই পর্যায়ে নিষ্পত্তির সংখ্যা কম।
বর্তমানে সারাদেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ লাখ ৫২ হাজারে। এক বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার। হাইকোর্টে এখন মামলা জমেছে ৬ লাখ ১৬ হাজার, নিম্ন আদালতে প্রায় ৪০ লাখ। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আপিল বিভাগ ২ হাজার ৭২টি, হাইকোর্ট ১০ হাজার ১৬১টি এবং নিম্ন আদালত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৬৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে। একই সময়ে নতুন মামলা এসেছে প্রায় ৩ লাখ ৯৪ হাজার। অর্থাৎ, নিষ্পত্তির চেয়ে মামলা দায়েরের হার এখনো বেশি। তবে আশার খবরও আছে। এ সময়ে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক মামলা নিষ্পত্তি করেছে এবং বিচারব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
দেশের আদালতব্যবস্থায় মামলাজটের অন্যতম বড় কারণ বিচারক সংকট। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, আপিল বিভাগে বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ মাত্র সাতজন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা ১১১ জন, আর নিম্ন আদালতে রয়েছেন ২ হাজার ১৮৭ জন বিচারক। এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান মামলার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। হাইকোর্টের ১১১ জন বিচারকের মধ্যে চারজনকে গত বছরের ১৬ অক্টোবর থেকে বিচারিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল। এছাড়া আরও তিনজন বিচারক বর্তমানে ব্যক্তিগত ছুটিতে রয়েছেন। ফলে বিচারকসংখ্যা আরও কমে গেছে।
সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদালতের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আদালত, পুলিশ, জেল, সাক্ষী, আইনজীবী ও অভিযুক্তদের একই নেটওয়ার্কে যুক্ত করা হবে। এতে মামলা ব্যবস্থাপনা দ্রুত হবে এবং আদালতের ওপর চাপ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিচারক সংকট মোকাবিলায় সুপ্রিম কোর্ট গত জানুয়ারিতে ‘জাজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট অর্ডিন্যান্স, ২০২৪’ জারি করেছে। এই অর্ডিন্যান্সের অধীনে গত ২৪ মার্চ হাইকোর্টের দুইজন বিচারপতিকে আপিল বিভাগে উন্নীত করা হয়েছে এবং হাইকোর্টে নতুন করে ২৫ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নিম্ন আদালতের মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে হাইকোর্টের বিচারপতিদের নেতৃত্বে ১৩টি মনিটরিং কমিটি গঠন করেছেন। এসব কমিটি জেলা আদালতের কার্যক্রম সরাসরি পর্যবেক্ষণ করছে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ সালিশের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রথা রয়েছে। তবে আইনি দিক থেকে সালিশের কোনো সুস্পষ্ট ভিত্তি নেই। কেবল গ্রাম আদালত ও পৌর কর্তৃপক্ষের সালিশই আইনি কাঠামোর মধ্যে পড়ে। বর্তমানে প্রতিটি গ্রামে মাসে পাঁচ থেকে দশটি সালিশ হয়— বছরে যার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ। তবে আইনজীবী নেতৃবৃন্দ মনে করেন, সালিশব্যবস্থার নিরপেক্ষতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক সালিশ সদস্য ব্যক্তিগত প্রভাব বা পক্ষপাত দেখিয়ে সিদ্ধান্ত দেন। তাই তারা মনে করেন, সালিশ প্রথাকে আইনগত কাঠামোর আওতায় এনে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি।
দেশে মামলাজট দীর্ঘদিনের সমস্যা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সালিশে বিরোধ নিষ্পত্তির সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আগের গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকায় যে পরিমাণ বিরোধ বা বিবাদ সৃষ্টি হয়, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশই আদালতে আসে। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ প্রচলিত সালিশ, ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালিত গ্রাম-আদালত ও সালিশী পরিষদের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। তবে ইউনিয়ন পর্যায়ের এই প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকরতার দিক থেকে সব জায়গায় সমানভাবে কাজ করছে না।
আইনজীবী স্বপন কুমার রায় জানান, মামলার জট নিরসনে শুধু নতুন বিচারক নিয়োগই যথেষ্ট নয়। “নিযুক্ত বিচারক বা আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ আরও জোরদার করতে হবে। ২-৩ মাস অন্তর অন্তর পুনরায় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এছাড়া এখনো কিছু ক্ষেত্রে নোটিস প্রতিপক্ষের কাছে পৌঁছাতে ২-৩ বছর লেগে যায়,” তিনি বলেন। তিনি এবং অন্যান্য আইনজীবীরা মনে করেন, “বিচারকরা অক্লান্তভাবে কাজ করছেন। আদালতের সীমিত সংখ্যা, বিচারকের অভাব—এই চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তারা দায়িত্ব পালন করছেন। তবে আদালতের চাপ কমাতে প্রশাসনিক ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।”
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ: ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট আইন কমিশনের একটি প্রতিবেদনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার জটের মূল পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা হয়—
- পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা
- বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না থাকা
- মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা
- জনবল ও প্রশাসনিক অভাব
- দুর্বল অবকাঠামো
এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বিচার বিভাগের সংস্কারের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেন এবং একটি কমিশন গঠন করেন। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ও মামলাজট কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ৩৫২ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে মামলাজট কমানোসহ ৩২টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশের মূল বিষয়গুলো হলো—
- সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
- বিচারক নিয়োগ ও পরিচালনায় কমিশন গঠন।
- অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া।
- অধস্তন আদালতের বিচারক সংখ্যা অন্তত ৬ হাজারে উন্নীত করা।
- বিচারক পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার।
- স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা।
- বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
- বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা।
- বিচার বিভাগের কার্যক্রমের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ।
- মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
বিচার বিভাগে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য এই সুপারিশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মামলাজট কমানো এবং ন্যায়বিচার দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য:
- পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের চুক্তিভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি,
- আদালতের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি,
- স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস চালু,
- বিকেন্দ্রীকরণ ও মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
সবই অপরিহার্য। আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, বিচার বিভাগের ওপর চাপ কমবে, মামলা নিষ্পত্তি দ্রুত হবে এবং সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।

