বাংলাদেশের দেওয়ানি আদালত ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে বিতর্কিত ছিল ‘সহকারী জজ’ পদবি। নামের মধ্যেই একটি ভুল বোঝাবুঝি লুকানো ছিল। সাধারণ মানুষ ভাবতেন, সহকারী জজ কোনো সিনিয়র জজের ব্যক্তিগত সহকারী বা প্রশিক্ষণরত কর্মকর্তা। তবে বাস্তবে তিনিও একজন পূর্ণাঙ্গ বিচারক, যিনি স্বাধীনভাবে দেওয়ানি মামলা, বিশেষ করে জমি ও মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ বিচার করেন।
বহু বছর ধরে এই বিভ্রান্তি বিচারককে বিব্রত করেছে। একই সঙ্গে সাধারণ বিচারপ্রার্থীর মধ্যেও আদালতের প্রতি অযথা সন্দেহ ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অবশেষে সেই বিভ্রান্তি দূর হলো। ১৯৮৭ সালে প্রবর্তিত সহকারী জজ পদবি দীর্ঘ ৩৮ বছর পর পরিবর্তন হয়ে ‘সিভিল জজ’ করা হয়েছে।
২০২৫ সালের ২ নভেম্বর জারি করা Civil Courts (Amendment) Ordinance, 2025-এর মাধ্যমে ‘সহকারী জজ’ ও ‘সিনিয়র সহকারী জজ’ পদবি বাতিল করে যথাক্রমে ‘সিভিল জজ’ এবং ‘সিনিয়র সিভিল জজ’ নামকরণ করা হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে দেওয়ানি আদালতের প্রাথমিক দুই স্তরের বিচারককে সিভিল জজ হিসেবেই পরিচিতি দেওয়া হবে।
কেন পদবির পরিবর্তন জরুরি ছিল:
‘সহকারী’ শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘সহায়ক’, ‘সহকারী কর্মচারী’ বা ‘শিক্ষানবিশ’ অর্থ বহন করে। এই কারণে অনেকেই ভাবতেন, সহকারী জজ আসলে কোনো সিনিয়র জজের সহকারী। অথচ সংবিধান অনুযায়ী, ১১৬(ক) অনুচ্ছেদে সহকারী জজকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
১৮৮৭ সালের Civil Courts Act-এ সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজের এখতিয়ার, কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। তাঁরা কারও সহকারী নন, বরং নিজেদের আদালতের স্বাধীন বিচারক। এই বাস্তবতা ও মর্যাদা পদবিতে প্রতিফলিত না হওয়ায় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, জেলা জজ এবং ইয়ং জাজেস ফোরাম বহু বছর ধরে পদবির পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। তদুপরি, ২০০৭ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র অবস্থানে আসে। এই প্রেক্ষাপটে ‘সহকারী’ শব্দটি বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
ইতিহাস বলে: ‘মুনসেফ’ থেকে ‘সহকারী জজ’, এখন সিভিল জজ:
বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমলে দেওয়ানি আদালতের নিম্নস্তরের বিচারককে ‘মুনসেফ’ বলা হতো। ১৯৮৭ সালে অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এই পদবি বদলে ‘সহকারী জজ’ করা হয়। কিন্তু নতুন পদবিও দীর্ঘদিন একই সমস্যার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এটি বাস্তব বিচারিক দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রকাশ করতে ব্যর্থ ছিল।
এই বিভ্রান্তি ২০২৪-২৫ সালে আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। বিচারক সমাজ এটিকে ‘মর্যাদাহানিকর’ ও ‘অযৌক্তিক’ বলে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব পাঠায়। অবশেষে ২০২৫ সালের Civil Courts (Amendment) Ordinance-এর মাধ্যমে সেই দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়।
সিভিল জজ কে এবং কীভাবে হন: বাংলাদেশে সিভিল জজ (সাবেক সহকারী জজ) হওয়া কঠোর নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভব। এই পরীক্ষা পরিচালনা করে Judicial Service Commission (JSC)। পরীক্ষার ধাপগুলো হলো:
- ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা
- ১০০০ নম্বরের ১০টি লিখিত পরীক্ষা
- ১০০ নম্বরের ভাইভা
এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে নিয়োগ পান এবং প্রথমে কর্মজীবন শুরু করেন সিভিল জজ বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। তাঁরা প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা এবং প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনারদের সমপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা। পদোন্নতির মাধ্যমে তাঁরা ক্রমান্বয়ে সিনিয়র সিভিল জজ, যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, জেলা ও দায়রা জজ হতে পারেন। অনেকে পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিও হয়ে যান।
দেওয়ানি আদালতের কাঠামো: বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ে বর্তমানে পাঁচ ধরনের দেওয়ানি আদালত কার্যকর রয়েছে:
১. জেলা জজ (জেলা ও দায়রা জজ)
২. অতিরিক্ত জেলা জজ
৩. যুগ্ম জেলা জজ
৪. সিনিয়র সিভিল জজ
৫. সিভিল জজ, সিভিল জজরা মূলত জমি, চুক্তি, বিবাহ, দেনা-পাওনা এবং মালিকানা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা বিচার করেন।
ফৌজদারি আদালত কেন আলাদা:
দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগর এলাকায় দেওয়ানি আদালতের পাশাপাশি রয়েছে ফৌজদারি আদালত। এখানে বিচার করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা। অপরাধের শাস্তির মাত্রা অনুযায়ী মামলাগুলো এই আদালতে বিভাজিত হয়।
মহানগর এলাকায় সিটি করপোরেশনভুক্ত অঞ্চলকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়ায় সেখানে রয়েছে মহানগর দায়রা আদালত ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ও বিচারিক সুবিধার জন্য গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ, সিটি করপোরেশন এলাকায় আলাদা আদালত কাঠামো রাখা হয়েছে যাতে মামলা পরিচালনা সহজ হয়।
সংশোধিত আইন কী বলছে:
২০২৫ সালের Civil Courts (Amendment) Ordinance অনুযায়ী ১৮৮৭ সালের Civil Courts Act-এর বিভিন্ন ধারায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেখানে আগে Assistant শব্দটি ব্যবহার করা হতো, সেখানে এখন Civil শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ফলে আইনের ভেতর থেকে Assistant Judge ও Senior Assistant Judge পদবির অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে উঠে গেছে। ধারাগুলো যেখানে সংশোধন আনা হয়েছে: Section 3, 4, 13, 19, 21, 22, 23, 24, 25 এবং নতুনভাবে Section 25A।
নতুন Section 25A-এর অনুযায়ী, পুরনো পদবিগুলো নিম্নরূপ গণ্য হবে:
- Additional Judge → Additional District Judge
- Subordinate Judge → Joint District Judge
- Senior Assistant Judge → Senior Civil Judge
- Assistant Judge → Civil Judge
এই পরিবর্তনের সুফল:
- বিচারকদের মর্যাদা সুরক্ষিত হবে।
- সাধারণ বিচারপ্রার্থীর ভুল বোঝাবুঝি কমবে।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটবে।
- পদবির নাম আন্তর্জাতিক মান অনুসারে হবে।
- ভবিষ্যতে পুনরায় পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘সহকারী’ শব্দটি বিভ্রান্তিকর ও মর্যাদাহানিকর। আর ‘সিভিল জজ’ নামটি বিচারকের প্রকৃত দায়িত্ব, ক্ষমতা ও পরিচয় যথার্থভাবে প্রকাশ করে।
নতুন এই সংশোধন শুধু একটি পদবি পরিবর্তন নয়। এটি বিচারিক মর্যাদার পুনরুদ্ধার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধির এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। সাধারণ বিচারপ্রার্থীর আস্থা ও বিশ্বাসও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক, সহজবোধ্য ও মর্যাদাসম্পন্ন করার পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক মাইলফলক। সূত্র: ‘ল’ ইয়ার্স ক্লাব

