সরকার ২০২৫ সালের অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন সংশোধনের গেজেট জারি করেছে। গত বুধবার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক মুদ্রণ শাখা থেকে গেজেটটি প্রকাশ করা হয়।
নতুন আইনটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত জালিয়াতি, অনিয়ম ও বাণিজ্যিক চক্র রুখতে করা হয়েছে। এতে দাতা নির্ধারণ, প্রতিস্থাপনের অনুমোদন, চিকিৎসকের যোগ্যতা, ইমোশনাল ডোনর, ক্যাডেভারিক ডোনেশন এবং সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্টসহ সব ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে। আইনে নজরদারি ব্যবস্থা, জাতীয় রেজিস্ট্রি ও শাস্তিমূলক কাঠামো যোগ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসা–সংক্রান্ত এই আইন আগের তুলনায় অনেক কঠোর ও প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
শুধু রক্ত–সম্পর্ক নয়:
গেজেটে অঙ্গদাতার সংজ্ঞায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগের আইনে দান অনুমোদন ছিল শুধু রক্তের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। নতুন সংশোধনে দাতাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
-
বায়োলজিক্যাল ডোনর: নিকট রক্ত–সম্পর্কীয়, প্রমাণযোগ্য জেনেটিক সম্পর্ক।
-
ইমোশনাল ডোনর: স্বামী–স্ত্রী, দত্তক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব বা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সম্পর্ক অর্থাৎ যে সম্পর্ক আর্থিক স্বার্থের ভিত্তিতে নয়।
-
ক্যাডেভারিক ডোনর: আইনগতভাবে মৃত ঘোষিত ব্যক্তির অঙ্গ দান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইমোশনাল ডোনরের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছে। তবে এটিই ভবিষ্যতে অনিয়মের প্রধান ঝুঁকির জায়গা হতে পারে। এজন্য গেজেটে ইমোশনাল ডোনরের জন্য কঠোর যাচাই, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন ও নৈতিক অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
‘ব্রেন ডেথ’ বা আইনগত মৃত্যুর বিস্তারিত সংজ্ঞা:
গেজেটে ক্যাডেভারিক দানের জন্য প্রথমবার মৃত্যুর মেডিকেল সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মস্তিষ্কের অপরিবর্তনীয় কার্যহীনতা, নিউরোলজিকাল রিফ্লেক্সের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, কোমা এবং আইসিইউ–সমর্থিত কৃত্রিম শ্বাস–প্রশ্বাসে জীবনধারণ—এই বিষয়গুলো সরকারি অনুমোদিত ডেথ সার্টিফিকেশন বোর্ড নিশ্চিত করবে।
এছাড়া, সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্ট বা রক্ত–গ্রুপ মেলেনি এমন ক্ষেত্রে বিনিময় পদ্ধতিও আইনগতভাবে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে উভয় পক্ষকে জাতীয় রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে অর্থাৎ, আর্থিক লেনদেন, মধ্যস্থতা বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রমাণিত হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্ট করা যাবে না।
জাতীয় রেজিস্ট্রিতে দাতা ও গ্রহীতার তথ্য বাধ্যতামূলক:
গেজেটে বলা হয়েছে, একটি জাতীয় অঙ্গ প্রতিস্থাপন রেজিস্ট্রি গঠন বাধ্যতামূলক। এতে থাকবে দাতা ও গ্রহীতার পরিচয় ও সামঞ্জস্যতা, কোন হাসপাতাল প্রতিস্থাপন করছে, সার্জনের অনুমোদন ও যোগ্যতার তালিকা, সোয়াপ ট্রান্সপ্লান্টের রেকর্ড, নৈতিক কমিটির সিদ্ধান্ত এবং ক্যাডেভারিক দানের তথ্য।
রেজিস্ট্রি সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং নিয়মিত অডিট হবে। দাতার ক্ষেত্রে কঠোর মেডিকেল স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বয়স, শারীরিক সক্ষমতা, রক্ত–গ্রুপ মিল, মানসিক সক্ষমতা, আর্থসামাজিক হুমকি বা জোরপূর্বক দানের ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রয়োজন হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন অন্তর্ভুক্ত। গ্রহীতার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় মেডিকেল প্রমাণ, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার সক্ষমতা এবং জীবন–ঝুঁকি সম্পর্কিত বোর্ড মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হবে।
হাসপাতাল ও সার্জনের দায়িত্ব কঠোর, অঙ্গ বিক্রিতে কঠোর শাস্তি:
নতুন অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে নির্ধারিত হয়েছে কোন হাসপাতাল বা সার্জন অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে পারবে। শর্তগুলো হলো: বিশেষায়িত ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট, নিবন্ধিত সার্জনদের তালিকা, আন্তর্জাতিক মানের আইসিইউ ও অপারেশন থিয়েটার, টিস্যু–টাইপিং ও এইচএলএ–ম্যাচিং ল্যাব। এছাড়া নৈতিক কমিটি ও ট্রান্সপ্লান্ট কো-অর্ডিনেটর বাধ্যতামূলক।
অঙ্গ বিক্রি, দাতা পাচার, জাল নথি, জোরপূর্বক দান, দালালি ও প্রতিস্থাপন চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি রাখা হয়েছে। জালিয়াতিতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল হবে। জোরপূর্বক দানের ক্ষেত্রে কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানা, মধ্যস্থতা বা দালালির জন্য অর্থদণ্ড ও ফৌজদারি মামলা, এবং অবৈধ প্রতিস্থাপনের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ধার্য করা হয়েছে। যদি কোনো চিকিৎসক আইন ভঙ্গ করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেন, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে বিচার হবে।
মৃতদেহ দান বাধ্যতামূলক নয়, উৎসাহিত হবে:
নতুন আইনে বলা হয়েছে, কেউ চাইলে জীবদ্দশায় সম্মতিপত্র দিয়ে মৃতদেহ দানের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবেন। মৃত্যুর পর স্বজনরাও সম্মতি দিতে পারবেন। তবে এতে কোনো আর্থিক লেনদেন চলবে না। আইন ধর্মীয় ও নৈতিক মতের প্রতি সম্মান রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এতে ভবিষ্যতে ক্যাডেভারিক দানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়বে।

