আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন সবার এক রকম নয়। কেউ এই পেশায় আসেন মর্যাদা ও যোগ্যতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষায়। আবার কেউ আসেন সমাজে ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক পরিচয়, পারিবারিক প্রভাব বা সুযোগের হাতছানি দেখে আইন পেশাকে ভবিষ্যতের সিঁড়ি ভাবেন।
আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে-একবার আইনজীবী হতে পারলে যেন সামনে স্বাচ্ছন্দ্যের পথ খুলে যায়, অর্থ ও মর্যাদার দ্বার উন্মুক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবতা এ ধারণার সঙ্গে সামান্যই মিল রাখে।
প্রথমদিনই শুরু হয় বাস্তবতার মুখোমুখি থাকা:
একজন নতুন আইনজীবী, যিনি বহু বছরের পড়াশোনা, চাপ ও প্রতিযোগিতা পেরিয়ে “ল” পাস করেছেন, যখন প্রথমদিন কোর্টের বারান্দায় দাঁড়ান-সেই দিনই তার স্বপ্নের বাইরের কঠিন বাস্তবতার প্রথম ঝলক দেখা দেয়। তিনি তখন শিক্ষানবিশ হাতে কোনো মামলা নেই, সামনে অনিশ্চিত পথ। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন-“সনদটা পেলেই নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু সনদ পাওয়ার পরও সব ঠিক হয় না। যোগ্যতা ও পরিশ্রমের সঙ্গে আয়ের সামঞ্জস্য নেই।
অনেকেই তখন নিজেকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে আইন পেশায় আসতে যে পরিমাণ পরিশ্রম লাগে, সেই পরিশ্রমের সঙ্গে আয়, মর্যাদা ও স্থিতিশীলতা কি সত্যিই সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছে হতাশাজনক। অসংখ্য তরুণ আইনজীবী নিয়মিত মামলা পান না। কেউ সিনিয়রের সঙ্গে বছরের পর বছর কাজ করেও স্বাবলম্বী হতে পারেন না। যাদের যোগ্যতা ও পরিশ্রম আছে, তারাও জায়গা না পেয়ে ভেঙে পড়েন। পেশার শুরুতে থাকতে হয় আর্থিক, মানসিক ও সামাজিক চাপের মুখে।
তবুও লড়াই ছাড়েন না তারা তবুও, আশ্চর্যভাবে, বেশির ভাগ তরুণ আইনজীবী হাল ছাড়েন না। কারণ তারা জানেন-এই পেশায় আসতে যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, যে দীর্ঘ প্রস্তুতি, তা পিছিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তাই তারা দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিদিন নিজেদের উন্নতি করেন। চেম্বার, কোর্ট, সিনিয়রদের নির্দেশনা, মামলা না পাওয়া-সবকিছুর সঙ্গেই লড়াই চালিয়ে যান। একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেন-এই বিশ্বাসই তাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। পেশার কাঠামোগত সমস্যাগুলো উপেক্ষা করলে চলবে না। আইন পেশায় প্রবেশ কঠিন-এটা স্বাভাবিক; কিন্তু প্রবেশ-পরবর্তী অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানযোগ্য। যেমন,
- আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়ণ,
- মামলার বণ্টনে অস্বচ্ছতা,
- নিম্ন আদালতে কর্মপরিবেশের সংকট,
- নতুন আইনজীবীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব,
- সিনিয়র-জুনিয়র ব্যবস্থার দুর্বলতা,
- এবং বার কাউন্সিলসহ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নানা জটিলতা।
এসব সমস্যাই নতুন প্রজন্মের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে। ন্যায়ের পেশায় ন্যায়চর্চা নিশ্চিত করা জরুরি। যে পেশা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেই পেশার নিজের ভেতরেও যদি অসমতা, অস্বচ্ছতা ও সীমাহীন প্রতিযোগিতা থাকে-তাহলে নতুন আইনজীবীদের জন্য সেটি একটি নৈতিক সংকট তৈরি করে। প্রশ্ন হলো যেখানে ন্যায়ের সৈনিক তৈরি হয়, সেই পথ যদি অন্যায় ও অবহেলায় ভরা থাকে, তবে ভবিষ্যতের আইনজীবীরা কীভাবে ন্যায়বিচারের আদর্শ রক্ষা করবেন?
সংশোধন জরুরি, আলোচনাও জরুরি। সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। তবে স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ, সুযোগের ভারসাম্য ও নতুন আইনজীবীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ এখনই নেওয়া প্রয়োজন। যাতে এই পেশায় যারা আসছেন তারা হতাশায় না ভেঙে পড়েন। যাতে যোগ্যরা পিছিয়ে না যান। যাতে আইন পেশা দেশের বিচারব্যবস্থার আসল শক্তি হিসেবে ফিরে দাঁড়াতে পারে। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন সুন্দর কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথ যেন কেবল ভাগ্যবানদের জন্য নয়-যোগ্যদের জন্যও সমান উন্মুক্ত থাকে, সে দায়িত্ব পুরো পেশার।
একটি প্রজন্ম আজ লড়ছে। তাদের এই লড়াই শুধু নিজের ভবিষ্যতের জন্য নয়-আইন পেশার মর্যাদা ও ন্যায়ের শুদ্ধতার জন্যও।
লেখক: মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
Email: advocatefindmy@gmail.com

