বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফি একটি বড় সমস্যা ছিল। ভর্তি হওয়ার পর হঠাৎ বিভিন্ন অজুহাতে ফি বৃদ্ধি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করত। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্বভাবে ফি নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছিল।
এ অবস্থার পরিবর্তন আনার উদ্যোগ হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২৫ (সংশোধিত) খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। নতুন খসড়ায় ফি কাঠামো ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টিউশন ফি নির্ধারণের আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ফলে ভর্তি হওয়ার সময় নির্ধারিত ফি পরে বাড়ানো যাবে না। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ফি কাঠামো সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি ধরা হবে। তবে তা অনুমোদিত ফি সীমার মধ্যে থাকবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আর কোনো অপ্রত্যাশিত ফি বৃদ্ধির শিকার হবেন না। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের ইচ্ছামতো ফি বাড়াতো এবং অনেক সময় লিখিত নোটিশও দেওয়া হতো না, যার কারণে শিক্ষার্থীরা অজান্তেই অতিরিক্ত ফি দিতে হতো। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সংশোধিত খসড়ায় শাস্তি হিসেবে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এর আগে শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং ৫ বছরের কারাদণ্ড। নতুন আইন কার্যকর হলে শিক্ষার্থীরা আর অপ্রত্যাশিত ফি বৃদ্ধির চাপের মুখোমুখি হবে না, যা তাদের জন্য দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান করবে।
আইনের খসড়ায় সার্টিফিকেট জালিয়াতি এবং অননুমোদিত কার্যক্রম পরিচালনার শাস্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম ন্যূনতম দুই বছর বন্ধ রাখার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, তদন্ত প্রক্রিয়ার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নিয়ম করা হয়েছে, যাতে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দাখিল করতে হবে। প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনে সময়সীমা আরও ৩০ দিন বাড়ানো যাবে। এতে যে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
প্রশাসনিক নিয়োগে স্বচ্ছতা: সংশোধিত আইনে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য সাত সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। এই কমিটি উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করবে এবং প্রতিটি পদের জন্য তিনজন প্রার্থীর নাম সুপারিশ করবে। এর ফলে প্রশাসনিক পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ হবে।
ট্রাস্টি বোর্ড ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: ট্রাস্টি বোর্ডে এক পরিবারের পাঁচজনের বেশি সদস্য থাকতে পারবে না। নতুন বিধান ট্রাস্টি বোর্ডে ক্ষমতার অপব্যবহার কমাবে এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
নতুন স্থাপনা ও অবকাঠামো শর্ত: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নতুন শর্তাবলী আরোপ করা হয়েছে। ২০১০ সালের আইনে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গার শর্ত থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার বর্গফুট করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের পাশে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক শব্দ ব্যবহার না করার প্রস্তাব রয়েছে, যাতে শিক্ষার্থী ও জনগণ বিভ্রান্ত না হন। এছাড়া ১ একর জমির বদলে ৫ একর জমি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে ২০২৪ সালের আগে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই শর্তে ছাড় পাবেন।
নতুন আইন কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে, অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে এবং শিক্ষার্থীরা আরও ভালো ও নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশে অধ্যয়ন করতে পারবে। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী অথচ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুযোগ নিশ্চিত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২৫ (সংশোধিত) খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ শতাংশ আসনে মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হবে। এ পদক্ষেপ বিশেষ করে গ্রামের বা পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার পথে বাধাহীন প্রবেশের সুযোগ নিশ্চিত করবে। আর্থিক কারণে কেউ যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংশোধিত আইন শুধু ফি বা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আর্থিক চাপের মধ্যে পড়বে না এবং একটি সুসংগঠিত, স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হবে। আইনের এই পরিবর্তন দেশের শিক্ষা খাতের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাস্তবায়িত হলে এটি দক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মঙ্গলজনক। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এগুলোর প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। এর ফলে মান উন্নয়নের প্রয়োজন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দিতে সক্ষম, অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও উচ্চমানের শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমের আধুনিকতা ও বৈচিত্র্য বাড়ানো এখন অপরিহার্য। বর্তমান যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এমন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা দরকার যা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে। উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন বিষয় যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যক্রম উদ্ভাবনী ও সময়োপযোগী হওয়া উচিত।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ভর করে তার শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চমানের শিক্ষক নিয়োগ করা জরুরি, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং গবেষণামুখী। শিক্ষকরা আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও কাজের সুযোগ পেলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া তাদের গবেষণার জন্য যথাযথ অনুদান ও সুযোগ দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা ও মানসম্পন্ন শিক্ষার সুবিধা পাবে এবং দেশের উচ্চশিক্ষা খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক ও বিশ্বমানের হবে।
বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ধারণে গবেষণা কার্যক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করলে তারা নতুন ধারণা, উদ্ভাবন ও সমাধান বের করতে সক্ষম হবে। গবেষণা প্রকল্পে বিনিয়োগ শুধু একাডেমিক মান বৃদ্ধি করবে না, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ, সহায়তা ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা অপরিহার্য। শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা বিশ্বমানের তত্ত্ব ও কৌশল শিখতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক ও বিশ্বজনীন চিন্তাভাবনা অর্জন করবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার প্রয়োজন অপরিসীম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২৫ (সংশোধিত) খসড়া শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করবে। আইন বাস্তবায়িত হলে টিউশন ফি সংক্রান্ত অসুবিধা, প্রশাসনিক অপব্যবহার ও অন্যান্য অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। নতুন আইন শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায়বিচারপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং উচ্চমানের শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এটি ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার একটি সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করবে।
লেখক : ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

