বিগত আট বছর ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন যারা তাদের সহযোগিতায় ব্যাংকটির প্রায় অর্ধেক ঋণ অনুমোদন দিয়ে লোপাট করার হয়। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) কর্মকর্তাদের অনেকে ছিলেন এসব ঋণ অনিয়মের সঙ্গী। এসব ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় লোপাট করা হয় ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এ ছাড়া যাঁরা স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন, তাঁরাও জড়িয়ে পড়েছিলেন অনিয়মের চক্রে। পুরোটা সময় ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন পর্যবেক্ষক থাকলেও তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ইতিমধ্যে ১ হাজার ৯২ কোটি আত্মসাতের অভিযোগে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক, বর্তমান এমডিসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় আসামি করা হয়েছে সাইফুল আলমের (এস আলম) ছেলে ও ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমকে। তবে অনিয়মের সঙ্গী অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি র্যাডিসন ব্লু হোটেলে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা সভায় নতুন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ঠিক করা হয়। আগের দিন একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার, ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক ও এমডি আবদুল মান্নানকে। ওই সভার আগেই তাঁরা ‘পদত্যাগ’ করেন। সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে নতুন চেয়ারম্যান করা হয়। এর আগে তিনি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
একই সভায় এমডি হিসেবে নিয়োগ পান তৎকালীন ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞা। একই দিন গভীর রাতে তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির এসব নিয়োগ অনুমোদন করেন। এরপর শুরু হয় ব্যাংকটির অর্থ লোপাট। অনিয়ম শুরু হলে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আরাস্তু খান পদত্যাগ করেন। এরপর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসান। তিনি মালিকানা পরিবর্তনের স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন। পরে চেয়ারম্যান হন এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আরমাডা স্পিনিং মিলের প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর সময়েই ব্যাংকটিতে বড় বড় অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকটির মনোনীত পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালকদের সবাই ছিলেন এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি, নিরীক্ষা কমিটিতে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা হলেন এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম, ডা. তানভীর আহমেদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল মতিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম উদ্দিন, মোহাম্মদ সালেহ জহুর, ব্যাংক কর্মকর্তা জয়নাল আবেদিন, আবু আসাদ, খুরশিদ উল আলম ও জিল্লুর রহমান, হিসাববিদ মোহাম্মদ সোলায়মান ও মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, ফশিউল আলম, বোরহান উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ সিরাজুল করিম, কাজী শহীদুল আলম, মোহাম্মদ কামরুল হাসান, কামাল হোসেন গাজী প্রমুখ।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবদুল হামিদ মিঞার মেয়াদ শেষে এমডি হন ব্যাংকটির ডিএমডি মাহবুব-উল আলম। এমডি পদে তাঁর মেয়াদ শেষ হলে এস আলম গ্রুপ তাঁকে প্রথমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের উপদেষ্টা ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়। এরপর তাঁকে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক করা হয়। ব্যাংক তিনটিই ছিল এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মাহবুব-উল আলমের মেয়াদ শেষ হলে এ পদে দায়িত্ব পান বর্তমান এমডি মুহাম্মদ মনিরুল মওলা। পরিচালক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা এস আলমের অর্থ লোপাটে সহায়তা করতে আপত্তি জানান, তাঁদের ব্যাংক ছাড়তে হয়।
ব্যাংকটির একাধিক সাবেক পরিচালক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নামে-বেনামে কোম্পানি তৈরি করে ঋণ প্রস্তাব পর্ষদে পাঠানো হলেও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা অনুমোদন হয়ে যেত। এসব ঋণ প্রস্তাব তৈরির জন্য ব্যাংকটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ও বিভাগে পদায়ন করা হয়। সরকার পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব ও ব্যাংকটির ডিএমডি আকিজ উদ্দিন ব্যাংকটিতে অবাধে জনবল নিয়োগ দেন। আর ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন অবাধে এস আলমের হাতে টাকা তুলে দেন। এসব কাজে কোনো বাধা দেয়নি ব্যাংকটির পর্ষদ।
ব্যাংকটির বর্তমান ও সাবেক বেশ কিছু কর্মকর্তা জানান, পরিচালকদের সভার সম্মানী ৮ হাজার টাকা হলেও সবাইকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। আর সাবেক এমডি মাহবুব-উল আলম, ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গুলশানে ‘দ্য অ্যাড্রেস’ ভবনে প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট বকশিশ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য সরকার পরিবর্তনের পর এসব সুবিধাভোগী কর্মকর্তা আর ব্যাংকে যাননি। এ ছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটি থেকে ৭৩ হাজার ১১৩ কোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, ব্যাংকটিতে এস আলম গ্রুপের সরাসরি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। আর পরোক্ষ ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। আর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ ৯ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।
কেবল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যেভাবে একটি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লুটপাট করেছে, তা দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিত পেয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সাংবাদিকদের জানান, ব্যাংকটি ঋণ হিসেবে যত অর্থ বিতরণ করেছে, তার অর্ধেকের বেশি টাকা একাই নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এসব ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখন বের করা হচ্ছে। এস আলমের ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ বন্ধক দেওয়া আছে, তারও পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের (ডিজিএফআই) সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করে এস আলম ও তাঁর সহযোগীরা ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ‘বের করে নিয়েছেন’। যেকোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ব্যাপক ব্যাংক ডাকাতি।
ব্যাংকটির একাধিক সাবেক পরিচালক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নামে-বেনামে কোম্পানি তৈরি করে ঋণ প্রস্তাব পর্ষদে পাঠানো হলেও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা অনুমোদন হয়ে যেত। এসব ঋণ প্রস্তাব তৈরির জন্য ব্যাংকটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ও বিভাগে পদায়ন করা হয়। সরকার পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব ও ব্যাংকটির ডিএমডি আকিজ উদ্দিন ব্যাংকটিতে অবাধে জনবল নিয়োগ দেন। আর ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন অবাধে এস আলমের হাতে টাকা তুলে দেন। এসব কাজে কোনো বাধা দেয়নি ব্যাংকটির পর্ষদ।
ব্যাংকটির বর্তমান ও সাবেক বেশ কিছু কর্মকর্তা জানান, পরিচালকদের সভার সম্মানী ৮ হাজার টাকা হলেও সবাইকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। আর সাবেক এমডি মাহবুব-উল আলম, ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গুলশানে ‘দ্য অ্যাড্রেস’ ভবনে প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট বকশিশ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য সরকার পরিবর্তনের পর এসব সুবিধাভোগী কর্মকর্তা আর ব্যাংকে যাননি। এ ছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা করেছে দুদক। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তানভীর আহমদ, সাবেক পরিচালক মো. ফসিউল আলম, কাজী শহীদুল আলম, মো. সিরাজুল করিম, জামাল মোস্তফা চৌধুরী, মো. জয়নাল আবেদীন, খুরশীদ উল আলম, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ সালেহ জহুর ও মোহাম্মদ সোলায়মান, পরিচালক মো. কামরুল হাসান ও সাবেক মনোনীত পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ। এ ছাড়া আছেন ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা, অতিরিক্ত এমডি মো. আলতাফ হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত এমডি মুহাম্মদ কায়সার আলী ও কে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, সাবেক ডিএমডি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ সাব্বির, কাজী মো. রেজাউল করিম প্রমুখ।
অনিয়মের বিষয়ে জানতে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক ও কর্মকর্তা মিলিয়ে ১০ জনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাঁরা ফোন ধরেননি। তবে সাবেক পরিচালক জয়নাল আবেদীনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, আমি একটি সরকারি ব্যাংকের ডিএমডি ছিলাম। আমাকে এমডি করা হয় নাই। ২০১৭ আমাকে গণভবনে থেকে ডেকে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকে পরিচালক পদের যোগ দিতে। পরে আমাকে পরিচালকের পাশাপাশি নির্বাহী কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম দিকে একটি ঋণের প্রতিবাদ করায় আমাকে নির্বাহী কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর পুরো আট বছর আমি শুধু ব্যাংকের পরিচালক পদে ছিলাম।
জয়নাল আবেদীন আরো বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় যে ঋণ প্রস্তাব আসত, তা সব পর্যায়ে অনুমোদন হয়ে আসত। শাখা, বিভাগীয়, বিভিন্ন কমিটি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুমোদন করে পর্যাপ্ত জামানত আছে বলে পর্ষদকে জানাত। এরপর আমরা এসব ঋণ অনুমোদন দিতাম।