সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলার অবকাঠামো উন্নয়নে বড় একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। বড় অঙ্কের ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরামর্শক নিয়োগ থেকে শুরু করে ভ্রমণ, গাড়ি কেনা, ভাড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ভাতা বাবদ অত্যধিক ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূলত চুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্য প্রকল্পে এসব খাতে এ ধরনের অত্যধিক ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়।
২ হাজার ১৪০ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হবে ১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। বাকি ৪০০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ‘বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি, ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্রজেক্ট (বি-স্ট্রোং)’ শীর্ষক এই প্রকল্পের আওতায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৬টি উপজেলার অবকাঠামো পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয় ও গ্রামীণ সড়ক পুনর্বাসন, আশ্রয়কেন্দ্র, সেতু ও কালভার্ট পুনর্নির্মাণ। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, বজ্রপাত সুরক্ষা ব্যবস্থা, সড়কবাতি স্থাপনসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হবে।
এলজিইডির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। এসব জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বন্যার ঝুঁকির বাইরে নিয়ে আসা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং দুর্গতদের সহায়তায় দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষাগত সুবিধা উন্নততর করা, অত্যাবশ্যক সেবাগুলো সহজলভ্য করার জন্য সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় দারিদ্র্য কমানোর কথা বলা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে।
প্রকল্পের আওতায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি বাবদ ১০৫ কোটি টাকা, শেল্টার পুনর্নির্মাণে ২০৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ১৫৫ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক পুনর্বাসনে ১৩৬ কোটি ৯০ লাখ, বিদ্যমান শেল্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ৭৮ কোটি ৬০ লাখ, অসম্পূর্ণ এমডিএসপি শেল্টার সম্পূর্ণকরণে ৫৯ কোটি, বিদ্যমান বিদ্যালয় পুনর্বাসনে ৭০ কোটি ২০ লাখ, ইমারজেন্সি অপারেশন সিস্টেম সরবরাহ ও স্থাপনে ৭৩ কোটি, আইসিটি ইক্যুইপমেন্ট ও ইনফ্রাজিআইএস খাতে ৫ কোটি ৫০ লাখ, বিদ্যালয়ের শিক্ষা উপকরণ বাবদ ১৭ কোটি টাকা, যন্ত্রপাতিসহ ল্যাবরেটরি সুবিধার উন্নয়নে ১৩ কোটি ৭০ লাখ, বজ্রপাত সুরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ, ৫৩৩ মিটার বক্স কালভার্ট পুনর্নির্মাণে ৪৮ কোটি ৯২ লাখ, ৬৪০ মিটার সেতু নির্মাণে ৯৩ কোটি ৬০ লাখ, ১৪০ কিলোমিটার খাল পুনঃখননে ৪২ কোটি টাকা ও ৪ হাজার সোলার স্ট্রিট লাইট বা সড়কবাতি সরবরাহ ও স্থাপনে ২৯ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পরামর্শক খাতে চাওয়া হয়েছে ১০৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, যা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের প্রায় ৫ শতাংশ। সাধারণত এলজিইডির প্রকল্পে পরামর্শক খাতে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২ থেকে ৩ শতাংশ অর্থ খরচ করা হলেও প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য চাওয়া হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ পরামর্শক নিয়োগে প্রায় দ্বিগুণ খরচ চাওয়া হয়েছে।
এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘এলজিইডির মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চালু থাকলেও প্রস্তাবিত প্রকল্পে দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ বাবদ চাওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়নে পরামর্শকের রাখার বিধান থাকে, সেটা ঠিক আছে। তবে এ কাজে তো আমাদের বিপুল অঙ্কের পরামর্শক দরকার নেই। কারণ এই টাকা তো আমাদের ফেরত দিতে হবে। তাহলে কেন আমরা এই খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করবো, এটা কোন ধরনের মানসিকতা। যেটার প্রয়োজন নেই সেটা করা তো অপব্যয়। ঋণ করে অর্থের অপব্যয় আমাদের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার এবং নির্মাণের নামে এ ধরনের কম্পোনেন্ট রাখা অর্থের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এগুলো মেনে নেওয়াও অনৈতিক।’
তিনি বলেন, ‘এ কাজগুলো তো এলজিইডি ৫০ বছর ধরেই করে আসছে। সেই কাজে পরামর্শক বা দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভ্রমণের কি প্রয়োজন আছে? প্রকল্পে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য কিছু না থাকলেও পরামর্শক, গাড়ি কেনা ভ্রমণ এসব থাকবেই—এ ধরনের খরচের খাত থাকলে চুরি ও দুর্নীতি করতে সুবিধা হয়। যারা এগুলো করছে তারা আগের মানসিকতা নিয়েই কাজ করছে। এত বড় একটা পরিবর্তনের পরেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি, আগের সেই গতানুগতিক ধারায় চলছে। যারা এখন ক্ষমতায় আছেন তারাও এদিকে খুব একটা দৃষ্টি দিচ্ছেন বলে মনে হয় না।’
এদিকে পরিকল্পনা কমিশনও এই প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডির প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ওপর গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। সভায় আলোচ্য প্রকল্পে পরামর্শক খাতে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বলা হয়। এ ছাড়া পিইসি সভায় প্রকল্পের আওতায় দক্ষতা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য বিভিন্ন খাতের অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব, নানা অসংগতিসহ প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতা বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে অত্যধিক খরচ ধরা খাতগুলোর ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়ে প্রকল্প সংশোধন করে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এলজিইডির সদ্য সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ মোজাক্কা জাহের বলেন, প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে। এ ধরনের প্রকল্পে তাদের কিছু শর্ত থাকে। সেই শর্ত অনুযায়ী পরামর্শক নেওয়া হয়।
নিজেদের অভিজ্ঞতা থাকার পরও কেন পরামর্শকের প্রয়োজন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এলজিইডিতে ডিজাইনার আছে; কিন্তু অতো ব্যাপকভাবে নেই। পাশাপাশি এ ধরনের প্রকল্পে অনেক কমপ্লায়েন্স থাকে, সেগুলোর জন্য পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। এলজিইডির কাজে সাধারণত পরামর্শক খাতে মোট ব্যয়ের ২ থেকে ৩ শতাংশ খরচ ধরা হয়।
দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে মোজাক্কা জাহের বলেন, দক্ষতা বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণের বিষয়টি এলজিইডির একটি নিয়মিত কাজ। নতুন যেসব কর্মকর্তা আসছেন তাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। আর প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া সহজ হওয়ায় সাধারণত দক্ষতা বৃদ্ধির খাত রাখা হয়।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে পরামর্শ নেওয়া ও দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্মাণকাজ, গাড়ি কেনা ও ভাতাসহ অন্যান্য বিভিন্ন খাতে অত্যধিক খরচ ধরা হয়েছে। প্রস্তাবে সাতটি ডাবল কেবিন পিকআপ কেনার জন্য ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে ৯৭ লাখ ১৪ হাজার টাকা। অথচ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য এ ধরনের গাড়ি কেনা হয় সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকায়। সেই হিসাবে প্রতিটি গাড়ির জন্য প্রায় দ্বিগুণ খরচ চাওয়া হয়েছে। গাড়ি কেনায় অতিরিক্ত খরচ ধরার পরেও ভাড়া বাবদ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি বাবদ ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা বাবদ ৮ কোটি টাকা এবং ঘোরাফেরার জন্য ৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেতু এবং রাস্তার টোলবাবদ ১৫ লাখ টাকা চেয়েছে এলজিইডি। যদিও এলজিইডির জন্য সব সেতু ও রাস্তায় টোল দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এ ছাড়া ৬০০ কিলোমিটার জরুরি গ্রামীণ রাস্তা পুনর্বাসনে খরচ ধরা হয়েছে ৮৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিদেশি ঋণের টাকায় এমন অত্যধিক ব্যয়ের প্রস্তাব অর্থের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের মতে, ঋণ করে পরামর্শক নিয়োগ এবং দক্ষতা বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যদি প্রযুক্তি বদলায়, তাহলে দক্ষতা আরও বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শকের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে; কিন্তু প্রস্তাবিত অবকাঠামো নির্মাণ বা পুনর্বাসনে প্রযুক্তির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সেখানে দক্ষতা উন্নয়নের খুব একটা প্রয়োজন নেই। তার পরেও প্রকল্পে পরামর্শক, দক্ষতা বৃদ্ধি, ভ্রমণ এ খাতগুলো রাখা হয় মূলত চুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটের সুবিধার্থে।