গত ২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকার মোহাম্মদপুরের নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন এসএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাদেক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় ‘চাঁদা আদায়ের চেষ্টা’র, সঙ্গে তাকে ‘ডিবি হারুন সিন্ডিকেটের সদস্য’ ও ‘ফ্যাসিস্টদের দোসর’ হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হয়। তবে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপক্ষ প্রথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গ্রেপ্তারের তিন দিনের মাথায় আদালত তাকে জামিন দেন।
গত ২৫ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে ব্যবসায়ী জুলফিকার মল্লিক একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২৩ সালে তিন দফায় তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং প্রায় ছয় কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। তবে ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, ডিবি কার্যালয়ে প্রবেশের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি আগন্তুকের তথ্য লগখাতায় লিপিবদ্ধ করতে হয়। অথচ ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি বা ২১ ফেব্রুয়ারি কোনো লগখাতায় জুলফিকার মল্লিকের নাম পাওয়া যায়নি।
ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ নিজ কার্যালয়ে ছিলেন না বরং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান ও মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় উঠে আসে, এই মামলার মূল কারণ ব্যবসায়িক লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধ। আবু সাদেকের দাবি, তার কাছে জুলফিকার মল্লিকের পাওনা ছয় কোটি ৬৪ লাখ টাকা রয়েছে। যা পরিশোধে দীর্ঘদিন ধরে গড়িমসি করছেন জুলফিকার।
আবু সাদেক জানান, ২০১১ সালে জুলফিকার মল্লিক তার অফিসে এসে ব্যবসায়িক সহায়তা চান। আমদানি করা কিছু পণ্য ছাড়াতে অর্থসংকটে পড়েছিলেন তিনি। সরল বিশ্বাসে সাদেক তাকে আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটি ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
জুলফিকার নিয়মিত মালামাল নিতে থাকেন এবং বিল পরিশোধের জন্য কিস্তিতে টাকা দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ব্যক্তিগত বিভিন্ন খরচের কথা বলে টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার কাছে সাদেকের পাওনা দাঁড়ায় ছয় কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
সাদেক জানান, পাওনা পরিশোধের জন্য জুলফিকার সাতটি চেক ইস্যু করলেও পরবর্তী সময়ে ব্যাংকে চিঠি দিয়ে সেগুলো স্থগিত করেন। এ ঘটনায় ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সাদেক শের-ই-বাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডির তদন্ত শুরু হলে জুলফিকার তাকে সমঝোতার প্রস্তাব দেন কিন্তু তারপরও টাকা পরিশোধ করেননি।
এরপর ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর জুলফিকার পাওনা ফেরত না দিয়ে বরং মামলার ভয় দেখাতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাদেকের বিরুদ্ধে ফ্ল্যাট দখল, গাড়ি ছিনতাই এবং হানি ট্র্যাপের অভিযোগও আনা হয়। যদিও মামলার কপিতে এসব অভিযোগের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।
আবু সাদেক জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটির উপদেষ্টা। তার অভিযোগ, তার রাজনৈতিক পরিচয়কে ব্যবহার করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন, জুলফিকার মল্লিকের ভাই পারভেজ মল্লিক যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা এবং তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সাদেক এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। যেখানে উল্লেখ করেছেন, ‘আমার পাওনা টাকা ফেরত না দিয়ে বরং আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে এবং দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে।’ তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডিবি, এনএসআইসহ বিভিন্ন দপ্তরে সুষ্ঠু তদন্তের আবেদন করেছেন।
রমনা বিভাগের এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আদালতের আদেশ অনুযায়ী আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে প্রাথমিক তদন্তে এজাহারে উল্লিখিত ঘটনার সত্যতা পুরোপুরি মেলেনি।’
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আব্দুল কাদের জানান- ‘তদন্ত চলছে, এখনও বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।’
অন্যদিকে, মামলার বাদী জুলফিকার মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি এবং পরবর্তীতে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর একাধিক ব্যক্তি ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ভুয়া মামলার শিকার হয়েছেন। এমনকি, অনেক বাদীই জানেন না যে তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। আবু সাদেকের মামলাটিও সেই একই ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়িক বিরোধ থেকে যদি সত্যিই এ মামলা হয়ে থাকে। তবে সেটি আইনিভাবে সমাধানের পথেই থাকা উচিত ছিল। তবে রাজনৈতিক ট্যাগ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সংযুক্ত হওয়ায় এটি নিছক ব্যবসায়িক লেনদেনের মামলা নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। তা তদন্ত সাপেক্ষে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।