মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আবেদন, পরীক্ষা, ফলাফল, সাক্ষাৎকার ও নিয়োগ—সবই সম্পন্ন হয়েছিল একদিনে। ঘটনাটি ছিল কর কর্মকর্তা পদে নিয়োগের। আবেদনকারী ব্যক্তি কোনো যোগ্যতাই পূরণ করেননি। বরং জমা দেন ভুয়া শিক্ষা সনদ। তারপরও তিনি নিয়োগ পান। ঘটনা ঘটে প্রায় ১৩ বছর আগে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)।
পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ। তৎকালীন প্রশাসন সেই কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুটি মামলাও এখনো চলছে। এত কিছুর পরও ডিএসসিসির বর্তমান প্রশাসন আবার তাকে চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে।
এই আলোচিত কর্মকর্তার নাম হাসানুজ্জামান। তাকে আবার নিয়োগ দেওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন ডিএসসিসির অনেক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া একজনকে আবার নিয়োগ দেওয়া মানে অনিয়মকে বৈধতা দেওয়া। এতে করপোরেশনের ভেতরে দুর্নীতি আরও বাড়বে। তারা দ্রুত হাসানুজ্জামানকে আবার চাকরিচ্যুত করার দাবি জানিয়েছেন।
তবে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, এখনও তাকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে করপোরেশনের আইন বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত পেলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদিও সচিবের স্বাক্ষরে একটি অফিস আদেশে তাকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই আদেশের কপি জাগো নিউজের হাতে এসেছে।
কীভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন হাসানুজ্জামান-
২০০৬ সালে ডিএসসিসি কর কর্মকর্তা পদে সরাসরি নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। তখন পদটিতে নিয়োগ বন্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন করপোরেশনের সাবেক উপ-কর কর্মকর্তা আ. আলিম খান। আদালত প্রথমে তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেন। পরে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বহাল থাকে। মামলাটি এখনো চলছে।
এরপরও ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর সব প্রক্রিয়া একদিনে সম্পন্ন করে হাসানুজ্জামানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেদিনই নেওয়া হয় মৌখিক পরীক্ষা, হয় বাছাই কমিটির সভা, তৈরি হয় ফলাফল, দেওয়া হয় নিয়োগপত্র। এমনকি সেদিনই তিনি যোগদানও করেন।
অভিযোগ রয়েছে, হাসানুজ্জামান আবেদনপত্রের সঙ্গে ভুয়া পে-অর্ডার জমা দেন। লেখেন তিনি ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম প্রি-কোয়ালিফায়েড (পিকিউ) পাস করেছেন। কিন্তু এই শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সমমান সনদ তিনি দেননি। আর ‘পিকিউ’ বিষয়টি নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। বাস্তবে শুধু এইচএসসি পাস হয়েই তিনি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে যান।
তখনকার মেয়র ছিলেন বিএনপির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তিনি দায়িত্ব ছাড়ার পর ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হাসানুজ্জামানকে চাকরিচ্যুত করেন তৎকালীন প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান। অফিস আদেশে বলা হয়, তিনি বেআইনিভাবে কর কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাই তার নিয়োগ বাতিল করা হলো।
আদালতের রায় ও পুনঃনিয়োগের প্রক্রিয়া-
চাকরিচ্যুত হওয়ার পর হাসানুজ্জামান উচ্চ আদালতে রিট করেন। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর সেই রিটের শুনানি হয়। আদালত তাকে পুনঃনিয়োগের আদেশ দেন। ডিএসসিসি এখনো এই আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেনি। ফলে হাসানুজ্জামান আদালতের আদেশের কপি ডিএসসিসির সচিব দপ্তরে জমা দেন।
এরপর ৯ মার্চ সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞা একটি অফিস আদেশে তাকে আবার কর কর্মকর্তা হিসেবে পুনঃনিয়োগ দেন। আদেশে বলা হয়, ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে তাকে স্থায়ী কর্মকর্তা হিসেবে ধরা হবে। ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি সব আর্থিক সুবিধাও পাবেন।
এই আদেশের পর নগর ভবনে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা। সচিব জানান, ওই আদেশ প্রশাসকের নির্দেশে জারি হয়েছে। কিন্তু পরে তিনি জানান, যোগদানপত্র পাওয়ার পর বিষয়টি আইন বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এখনো কোনো চূড়ান্ত মতামত আসেনি।
ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সচিব কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই পুনঃনিয়োগ দেন। তিনি নাকি মোটা অংকের ঘুষ নিয়েছেন—এমন গুঞ্জনও রয়েছে। আর এই নিয়োগ কার্যকর হলে করপোরেশনকে দিতে হবে হাসানুজ্জামানের বকেয়া প্রায় ৭৫ লাখ টাকা।
অডিট আপত্তি ও আগের মন্তব্য-
২০১২ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর হাসানুজ্জামানের নিয়োগ নিয়ে আপত্তি তোলে। তারা জানায়, এই নিয়োগ ছিল অনিয়মিত। ডিএসসিসিকে জবাব দিতে বলা হয়। করপোরেশন তাদের উত্তরে জানায়, আপত্তি ‘সঠিক’ এবং ‘মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন’। তখন অধিদপ্তর জানায়, এই উত্তর গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়োগ বাতিলসহ আদায়ের পদক্ষেপ নিতে হবে।
হাসানুজ্জামানের বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, আদালতের সব কাগজ যাচাই চলছে। এখনো কোনো চূড়ান্ত মতামত দেওয়া হয়নি। করপোরেশনের স্বার্থে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দীর্ঘদিন আগের এক অনিয়মিত নিয়োগ, যার কারণে চাকরি হারিয়েছিলেন হাসানুজ্জামান। কিন্তু সেই নিয়োগকেই আবার বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। আদালতের আদেশ, সচিবের সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক মতবিরোধ—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে জটিল পরিস্থিতি। এখন দেখার বিষয়, ডিএসসিসি শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন একটাই—একজন ভুয়া সনদধারীর পুনঃনিয়োগ কি সত্যিই ন্যায়বিচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?