পুঁজিবাজারে আসার প্রলোভন দেখিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির নামে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বস্ত্র খাতের বিতর্কিত কোম্পানি রয়েল ডেনিম লিমিটেড। মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও এক দশক পরও কোনো শেয়ার হস্তান্তর করেনি এমনকি দেয়নি কোনো লভ্যাংশও। এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে এখন চরম বিপাকে পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাধারণ বিমা কোম্পানি রূপালী ইন্স্যুরেন্স।
২০১৩ ও ২০১৪ সালে রয়েল ডেনিম চার কোটি তিন লাখ ৩৭ হাজার ৫০০টি প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে। এসব শেয়ার ১০ টাকা করে ৬০টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কিনলেও এখন পর্যন্ত কেউই লাভ তো দূরে থাক শেয়ার হস্তান্তরই পাননি। রূপালী ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পাঁচ লাখ শেয়ারের বিনিময়ে ৫০ লাখ টাকা আগাম পরিশোধ করলেও শেয়ার থেকে কোনো বিনিয়োগ রিটার্ন পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে সম্প্রতি নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান এ ওয়াহার অ্যান্ড কোং ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তুলেছে এবং এ ধরনের অস্বচ্ছ লেনদেন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
রূপালী ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আতিকুর রহমান রয়েল ডেনিমের সঙ্গে শেয়ার কেনাবেচার বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই এবং খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। এমনকি প্রধান অর্থ কর্মকর্তা জেহাদুল করিমও রয়েল ডেনিমে তাদের কোনো বিনিয়োগ আছে কি না তা নিশ্চিত করতে পারেননি। বারবার যোগাযোগের পরেও কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী পি কে রায় বা অন্য কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
রয়েল ডেনিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ঘোষণা দিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করলেও সেই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়। ২০১৬ সালে স্বদেশ ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও সিগমা ক্যাপিটালের সঙ্গে আইপিও আনার চুক্তির ঘোষণা দিলেও ৬০ কোটি টাকা তুলতে চাওয়া উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৯ সালে কভিড-১৯ মহামারির ধাক্কায় কোম্পানির ব্যবসা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা তখনও শেয়ার বা লভ্যাংশ না পেয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কোম্পানিটির ব্যবসা কার্যক্রম প্রায় চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। কুমিল্লার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) অবস্থিত রয়েল ডেনিমের কারখানা লোকসানে বন্ধ হয়ে পড়ে। শ্রমিকদের ছয় মাসের বেতন এবং ইপিজেডের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। এতে বেপজা কোম্পানিটির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং সম্প্রতি কারখানার অবকাঠামো অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বরাদ্দ দিতে প্রস্তুতি নেয়। কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব জানান, চলতি মাসেই প্রতিষ্ঠানটিকে নিলামে তোলা হচ্ছে।
বিনিয়োগকারী তালিকায় কেবল রূপালী ইন্স্যুরেন্সই নয়, রয়েল ডেনিমের চেয়ারম্যান এএম সাইদুর রহমান, মীর হাসান আলী, আদনান ইমাম, সাদিয়া পারভীন, আফসারউজ্জামান, মিজানুর রহমান ও দিপালী চৌধুরীসহ মোট ৬০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে কেউই আজ পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশ পাননি।
বিশ্লেষকদের মতে, ডেনিম বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী। প্রতিবছর প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের ডেনিম পণ্য রপ্তানি হয় বিশ্ববাজারে। এমন সম্ভাবনাময় খাতে রয়েল ডেনিমের মতো কোম্পানির প্রতারণা শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতিই নয় বিনিয়োগকারীদের আস্থারও বড় ধাক্কা। ডেনিমের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে রয়েল ডেনিম কোটি কোটি টাকা তুললেও বিনিয়োগকারীরা এখন সেই বিনিয়োগ রক্ষা নিয়েই দুশ্চিন্তায়।
২০১৪ সালে মীর কাশেম আলীর পরিবার রয়েল ডেনিমের শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার পর কোম্পানিটির মালিকানা চলে যায় এনজিওভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভিওএসডি’র চেয়ারম্যান এএম সাইদুর রহমানের হাতে। এনজিওটির নির্বাহী পরিচালক একেএম মোস্তাফিজুর রহমানও রয়েল ডেনিমের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হন। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
রয়েল ডেনিমের বর্তমান অবস্থান নিয়ে জানার জন্য বারবার চেষ্টা করেও কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল হোসেনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সাক্ষাতের কথা বললেও পরে আর কোনো সময় দেননি।
এই ঘটনায় প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর অনিয়ম, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা এবং কোম্পানির দেউলিয়াত্বের ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাদের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি এমন প্রতারণার ঘটনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব ও তদারকির বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে।

