দেশের জীবনবিমা খাতে গ্রাহকদের টাকা ফেরত না পাওয়ার ঘটনা এখন একরকম নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিমা করেছেন, কিস্তিও দিয়েছেন নিয়মিত কিন্তু মেয়াদ শেষে টাকা তুলতে গিয়ে বছরের পর বছর ঘুরেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৩২টি জীবনবিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ অন্তত ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
এ টাকা ফেরত পেতে প্রতিদিনই রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় এসব কোম্পানির অফিসে ধর্না দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। কারও কেউ নেই এই অবস্থায় আইডিআরএ এমনকি আদালত পর্যন্ত গিয়েও কোনো সুরাহা মিলছে না অনেকের।
বাগেরহাটের আশিকুর রহমান আশিক তাদেরই একজন, যিনি প্রায় ২১ বার ঢাকায় এসে বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে ঘুরেছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকার বিমার টাকাটি পেতে। ২০০৫ সালে বিমাটি করেছিলেন, মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১০ সালে। কিন্তু দীর্ঘ ১৪ বছরেও তিনি অর্থ ফেরত পাননি। আশিক বলেন, “এজেন্ট আর কোম্পানির লোক বলেছিল, ৫০ হাজার দিলে ১ লাখ পাব। এখন লাভ তো দূরে থাক নিজের টাকাটাই ফেরত পাচ্ছি না।”
কুড়িগ্রামের রিকশাচালক সুজন খন্দকার ৯ বছর ধরে একই কোম্পানির পেছনে ছুটছেন। বগুড়ার মুহতাদিয়া বানু চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৪ বছর ধরে। তবুও কারও টাকা ফেরত আসেনি।
আইন অনুযায়ী, বিমা মেয়াদ শেষ হলে এবং গ্রাহক প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিলে ৯০ দিনের মধ্যেই বিমা দাবি নিষ্পত্তি করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বেশিরভাগ কোম্পানি এই নিয়ম মানছে না।
আইডিআরএ’র হিসাবে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বকেয়া বিমা দাবির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বজনপ্রীতি, তহবিল লোপাট ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে কোম্পানিগুলো অর্থ সংকটে পড়ে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।
আইডিআরএর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গ্রাহকের আটকে থাকা অর্থের ৮০ শতাংশই আটকে রেখেছে মাত্র ৫টি জীবনবিমা কোম্পানি। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের মালিকানাধীন সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনস্যুরেন্স। এই কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের পাওনা ৫৯৯ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং তারা বিমা দাবির ৯৭.৮৭ শতাংশই পরিশোধ করেনি। কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এস আলম গ্রুপের পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স। তাদের কাছে গ্রাহকদের দাবির পরিমাণ ২৬১ কোটি টাকা এবং পরিশোধ না করা হার ৯৫.৫১ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, যেখানে দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা মোট দাবির ৯৩.৪১ শতাংশ অপরিশোধিত। এই কোম্পানিতে এস আলম গ্রুপ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ভারপ্রাপ্ত সিইও শহিদুল ইসলাম স্বীকার করেন, গত ১০-১২ বছরে কোম্পানি থেকে প্রায় ৩২০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। তিনি জানান, নগদ অর্থের সংকট থাকায় গুলশান ও ফেনীর সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে টাকা পরিশোধের পরিকল্পনা রয়েছে।
যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ আবুল বাসারের বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স ৯২.৫৮ শতাংশ দাবি বকেয়া রেখেছে, যার পরিমাণ ৮৩ কোটি টাকা। কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত সিইও মামুন খান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে বড় অংশের দাবি পরিশোধ করা সম্ভব হবে এবং এ জন্য মালিবাগের জমি বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্স ২০১ কোটি টাকার ৮২.৩২ শতাংশ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সানলাইফ ইনস্যুরেন্স ৭৩ শতাংশ, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিনের বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ৪৯.৮ শতাংশ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসহাক আলী খান পান্নার ডায়মন্ড লাইফ ৩৩ শতাংশ এবং সরকারি মালিকানাধীন জীবনবিমা কোম্পানি ১৪ শতাংশ দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ১০ শতাংশ এবং সাবেক এমপি মোরশেদ আলমের মালিকানাধীন ন্যাশনাল লাইফ ৮ শতাংশ বিমা দাবি বকেয়া রেখেছে। প্রাইম ইসলামী লাইফের সিইও সামসুল আলম অবশ্য দাবি করেন, বকেয়া টাকার পরিমাণ ৩৮ কোটি এবং কোম্পানি ইতোমধ্যে ফ্ল্যাট ও প্লট বিক্রি করে পরিশোধ শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এক দশক আগেও দেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ শতাংশ যা বর্তমানে নেমে এসেছে মাত্র ০.৪৫ শতাংশে। এটি প্রমাণ করে, খাতটির বিস্তার থাকলেও মানুষের আস্থা কমে গেছে। এর মূল কারণ বিমার অর্থ সময়মতো পরিশোধ না করা। এতে করে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও শৃঙ্খলা সংকট তৈরি হচ্ছে।
প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সের সিইও জালালুল আজিম বলেন, ‘বিমার টাকা ফেরত না পেলে মানুষ বিমা খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে করে খাতটি দেশের অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না।’
তবে সংকটের মধ্যেও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, সোনালী লাইফ, মার্কেন্টাইল, সন্ধানী, মেঘনা ও রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স।
এ বিষয়ে আইডিআরএর চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানির অনিয়ম পুরো খাতকে হুমকির মুখে ফেলছে। আমরা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছি। সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিনা শেখের মতে, শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না আইডিআরএকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজন হলে অনিয়ম করা কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।
জীবনবিমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে হলে এই খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যথায় গ্রাহকের টাকা আটকে থাকার এই চক্র কখনোই ভাঙবে না।

